Saturday, 11 December 2021

লক্ষ্মী হিজড়েনী আর এক রাতের কথা

সাতকাহনিয়ার   সাতকাহন কথা।।
।।। লক্ষী হিজড়েনী আর এক রাতের কথা।।

আকাশে একফালি চাঁদ।
বাঁধের গায়ে বিরাট যজ্ঞডুমুর গাছটার উপরে ভেসে আছে।
যজ্ঞডুমুরের একটা মোটা ডাল বাঁধের উপরে আড়াআড়ি ভাবে। তার তলা দিয়েই যেতে হবে।
গাঁয়ের লোকেরা বলাবলি করে ঐ ডালে পা ঝুলিয়ে ওনারা বসে থাকেন। পা নাচায়। নিজে চোখে কেউ কেউ দেখেছে ও।
একজন তো ঘরে এসে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।
হবে নাই বা কেন!  পাশেই নদী। নদীর পাড়ে শ্মশান। বিরাট শিমূল এর নীচে। ওপাশে ঘন পলাশবন। ঝিঁঝি ডাকে কান পাতা দায়। আর লক্ষ লক্ষ জোনাকি।
  হিজলের তলা দিয়ে ' গই ' পেরিয়ে পায়ে চলা বা গোরু র গাড়ি  রাস্তা চলে গেছে " ভুলো কালী " তলার বিরাট ঝাঁকড়া
অশ্বত্থ গাছটা র পাশ দিয়ে কয়া মাঠ ; কামারপাড়ার দো মাঠ
রূপাই চণ্ডী তলা হয়ে বসুধার রূপুটে পাড়ার দিকে।
  ইলামবাজার থেকে ফিরতে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত। কলেজ থেকে ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। আকাশে মৃদু আলোয় দূর থেকে দেখতে পাচ্ছে লাঠি হাতে কেউ দাঁড়িয়ে আছে বাঁধের উপরে।
আর এগুতে সাহস হচ্ছেনা। ভাবছে  চোর ডাকাত কি। না একা তো। আবার ভাবছে ;আর তার কাছে আছেই বা কি। ঝোলায় কয়েকটা বই মাত্র।
  কিন্তু সাইকেল টা যদি নিয়ে নেয়! তাহলে -
পিছনে ফিরে যাবে?
সে তো অনেক সময় যাবে। ঘরে দাদু দিদিমা ছটফট করবে।
  সে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
   ও আগিয়ে আসছে। থপথপ করে। আসুক -
  একেবারে কাছে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সাইকেলের হ্যাণ্ডেলের উপর। তারপর সাইকেল ছেড়ে জড়িয়ে ধরল তাকে।
গায়ে বেশ জোর। লক্ষী হিজরে।
মুখে পচাই মদের বিকট গন্ধ।
" শালা তু কে রে "।  " ও  অযুধ্যের  অমুক রক্ষিতের ব্যাটা "।
শালা সেদিনে তু খুব গাল দিয়েছিলি। আজ শালা তোকে ছাড়ছি না। 
চল আমাকে ইলামবাজারে পৌঁছে দে "। আমি যেতে লাড়ছি "
- না। লক্ষী দিদি আমি সাতকাহনার মাষ্টার এর লাতি "
- শালা। মিছে কথা। শালা আমি কারও দিদি লই। দাদা লই "
  আমি লক্ষী হিজরে মাগি। চল শালা চল। "
যতই ছাড়াবার চেষ্টা করি ততই সে আরও জোরে চেপে ধরে।

লক্ষী হিজড়েনী । ইলামবাজারের পাঁচু সাহার পচুই মদশালেই
তার আস্তানা। বট গাছের তলায়। ইলামবাজার থেকে অযোধ্যা বনকাটি এলাকা। এই তার এলাকা। এখানে তার সাথে ঢোলক বাজায় অষ্ট মেটে। বিচিত্র গলায় লক্ষী তালি দিয়ে গান গায়। ছেলে নাচায়। চাল মুড়ি নাড়ু দু চার টাকা  পয়সা আদায় করে। নিয়ে সন্ধ্যায় ধ্বজাই সাহার পচুই মদ শালে। সেখানের চালাতেই রাত পেরিয়ে যায় তার আর অষ্ট র।
অষ্ট র ঘর মদশালের পাশেই।তার সংসার আছে।  সহজে লক্ষী তাকে ছাড়েই না। অষ্ট কে সে এখানে নিয়ে এসেছে।
মাটির বড় ঘর করে দিয়েছে। বাবুদের ঘরে চাষ দেখে দিয়েছে। 
  একটু ভারী চেহারার লক্ষী। মেয়ে হয়েই জন্মাতে জন্মাতে
হঠাৎ আর পুরোটা হয়নি। এদের নিয়ে মানুষের ; ছেলে মেয়েদের কত কৌতূহল। অথচ মুখ ফুটে পরিষ্কার করে কেউ
কিছু বলেও না। জিজ্ঞেস ও করা যায়না।
মানুষ। অথচ এক বিচিত্র জীব।
  সে ও জন্মেছে কোন মায়ের গর্ভে। হায়রে সে মায়ের গর্ভের
নির্মিতি। হায়রে সে মায়ের মন। যখন তুলে দিতে হয়েছে তার
গর্ভের সন্তান টিকে সেই হিজরে দের হাতেই।
আর কি বিচিত্র জীবন  এই হিজরে দের।
চিরদিন ই তারা আছে। কিন্তু মানুষের সমাজ মানেনি। কি
সেদিন আর এদিন। 
  লক্ষীরা অল্পে সন্তুষ্ট ছিল। আর এখন দল বেঁধে এসে আধুনিকা রা  যারপরনাই অত্যাচার করছে। জোর করে গরীব মানুষের ঘর
থেকে হাজার হাজার টাকা ; শাড়ি এসব আদায় করছে।
তাদের মুখের সামনে দাঁড়ায় কার সাধ্যি। আর যদি কেউ বেশী
কিছু বলে   দল বেঁধে গোল হয়ে দাঁড়ায় তবে যা পরে আছে সব খুলে নেচে দেবে। মেয়ে বৌ রা যে যেদিকে পারবে ছুটে পালাবে। এই সেদিন এই গাঁয়ে কোঁড়া পাড়ায় এক ঘরে এমন করে আদায় করে নিয়ে গেল।
এভাবে আদায় করায় সরকারের অনুমতি আছে? ওরা বলে হ্যাঁ আমাদের কাগজ আছে। যা না যা যেখানে যাবি যা। "
হাসপাতাল থেকে নাম পেয়ে যাচ্ছে।
একটা চমৎকার নেটওয়ার্ক আছে - মনে হতে বাধ্য।
কিন্তু লক্ষীরা এমন টি ছিলনা। মনে পড়ে ছোট বেলায় আমাদের বাড়িতেও ওকে আসতে দেখেছি। দাদু কে পেন্নাম ও
করত। ভাত ও খেয়ে গেছে  কখনো কেমনো।
  আচ্ছা ঢোলক বাদকের সাথে ওর সম্পর্ক কেমন ছিল।
আমার তো মনে হত বেশ আন্তরিক। এক ধরনের ঘনিষ্ঠতা।
  এদের কি মন নাই!  শরীরের খিদে নাই!  কামনা বাসনা!
  আজও আমরা লক্ষী দের চিনি না। বা চিনতে চাই ও না।
  কি হবে এদের চিনে। এরা তো মূল স্রোতের কেউ নয়।
  কিন্তু এরা ও যে মানুষের গর্ভে জন্মেছে। তাদের ও বাঁচতে হবে।  বাঁচতে দিতে হবে। বাঁচার উপায় খুঁজে দিতে হবে।
শুধু দল বেঁধে ট্রেনে উঠে যাত্রী দের কাছে আদায়। যেমন দল
বেঁধে ওঠে মালদা - গৌড় স্টেশনে।
  আমি জানিনা। আছে কি না। একটা গণনা দরকার। তাদের
নিজস্ব কলোনি গড়ে দেওয়া ;শিক্ষার ; হাতের কাজের প্রশিক্ষণ দরকার ।  সরকার কে সহানুভূতিশীল হতে হবে।

  অনেক কাকুতি মিনতি তে ও সেদিন লক্ষীর হাত থেকে ছাড়া
পাইনি। লণ্ঠন হাতে নিয়ে নদী তে মাছ ধরতে আসা কয়েকজন কে মনে হল এদিকেই আসছে। শ্মশান ঘাটের কাছে নামবে।
  ঠিক তাই। মাল পাড়ার পদ ; ভোঁটা ; লেডু মালেরা। খুব
মেছোল। ভয় ডর নাই। তেমনি গতর। আর এই সময় ভালো মাছ ওঠে। আড় ; বোয়াল ; সহ নানা মাছ।
কোনমতে তাদের কাছে আমার ডাক পৌঁছালো।
  ওরা এসে আমাকে ছাড়াল।
ওরাই বলল "  এই লক্ষী এত রাতে আর তুই ইলামবাজার যেতে পারবিনা। " যাসনা। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল সে। তারপর
জিয়ল গাছের তলায় ধপ করে বসে পড়ে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলো।
কেন যে কাঁদতে লাগলো       কে জানে! 
রাতের আঁধারে নদী তীরে তার কান্না ছড়িয়ে গেল চরাচরে।
------------ ------------ ------------  - -----------©  প্রণব ভট্টাচার্য।

------------ ------------ ------------ ------------ -------©  প্রণব ভট্টাচার্য
।। কথা - সাতকাহন।। এর অংশ।

No comments:

Post a Comment