Sunday, 31 August 2025

আয়। আয়। বড় তাড়াতাড়ি এলি

।। আয়। আয়। 
বড় তাড়াতাড়ি এলি। 
সেই নারীকে আসতে দেখে, কাপালিক মনে মনে বললেন। 
গ্রামের একেবারে শেষ, পূর্ব প্রান্তে, পাশাপাশি তিনটি পুকুর। তারপরেই চাষের মাঠ। তিনটি পুকুরের পাড়েই তিনটি বিরাট বটবৃক্ষ। 
দক্ষিণ দিকের পুকুরটি ঘোষদের। তার দক্ষিণ পাড়ে এই ঝাঁকড়া বটবৃক্ষের তলে কাপালিকের কুঁড়ে। জটাজুট ধারী। দশাসই চেহারা। গৌর বর্ণ। এখন তামাটে। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। আবার মানুষের হাড়ের মালা। সামনে মাটি দিয়ে বাঁধানো বেদী। তার উপরে বসে কাপালিক সাধনা করেন। বেদীর ভিতরে পাঁচটি মানুষের মাথার খুলি। পঞ্চমুণ্ডি আসন। সামনেই গভীর শাল জঙ্গল। 
সন্ধ্যা সমাগত প্রায়। শিবাদের দল জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছে। পুকুরে দল বেঁধে জল খাচ্ছে। 
পাশের বামুনপুকুরের পাড়ের বটবৃক্ষ টিতে অসংখ্য বাদুড় আর প্যাঁচার বাস। মাঠের ইঁদুর ধরে খায় আবার 
অধিকারী আমবাগান আর জঙ্গলের নানা ফলের গাছের ফল মূল ও খায়। প্যাঁচা দের দল উড়ে গেল। বাদুড়ের ঝাঁক উত্তরে খেলারামতলা হয়ে উড়ে গেল নদীর ধারে। বাঁধের ধারে বিরাট যজ্ঞডুমুরের গাছ। বড় বড় পাকা ডুমুর বেশ মিষ্টি। 
অনেকের সেখানে বাস। পাকা ডুমুরের লোভে অনেকে এসে জোটে। ভুলো কালী তলার বিশাল অশ্বত্থের কোটরে বাসা অনেক পাখির। বকেরা দল বেঁধে থাকে। এখন সব বাসার নিশ্চিন্তিতে। 
আকাশে একটা ভাঙা চাঁদ ঝুলে আছে। 
কাপালিক তাঁর আসন ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যে চলে গেলেন। জানেন সেখানে একটা বেশ বড় ছাতিম গাছ আছে। একটা ডাল তার মাটির দিকে ঝুঁকে আছে। সেদিকেই গেছে গাঁ থেকে আসা সেই নারী। 
গায়ে তার একটা শাড়ি জড়ানো। 
বড় তাড়াতাড়ি চলে গেলি। কাপালিক মনে মনে বলেন।  ঠিকই তাই। সেই নারী কাপড়ের আঁচল দিয়ে গলায় ফাঁস জড়িয়ে ছাতিমের ডালে ঝুলে পড়েছে। কিছুক্ষণের ছটফটানি। তারপর সব শেষ। পড়ে থাকল, গাঁ ঘর। স্বামী, সংসার। 
কিসের জ্বালায় মরল এই নারী। বেনে ঘরের বৌ। 
স্বামী, শ্বশুর দের পয়সার অভাব নাই। ব্যবসার টাকা। নুনের ব্যবসা আবার গুড় থেকে লাল চিনি তৈরী র ব্যবসা।  স্বামী টি দেখতে শুনতে ফুল বাবু। এক নারীতে তার মন ভরেনা। অযোধ্যার বেনে পাড়ায় তার আরও কয়েকজন আছে। এই বৌ ভাবে তারা কি আমার চেয়েও সুন্দরী। 
আমার মতো গায়ের রঙ। এই রকম হলদে উজ্জ্বল ফর্সা। এই রকম শরীর। না হয় তার বাচ্চা কাচ্চা হয়নি বিয়ের অনেক গুলো বছর পরেও। 
গাঁ ঘরে তো নানা কথা থাকবেই। আছেও। “ আঁটকুড়ী “। তার আবার রূপের গিদের “। প্রতিদিনই শোনে। বুকের ভিতর টা জ্বলে যায়। 
কোন কোন রাতে স্বামী ঘরে ফেরেনা। 
‘’ কেন ফিরবে লো ‘’!  কি আছে তোর! ‘’ পারিসনি কেন বেঁধে রাখতে ‘’। দেখগে যা, দত্ত বাড়ির মেয়ে টাকে কি সুন্দর সোনার হার গড়িয়ে দিয়েছে। আর তোর!  ঐ তো তাঁতি ঘরের মোটা একটা শাড়ী।’’
বাউরী ঘরের পাকা  রসবতী বৌ ফুলটুসি বলে, তুই ও দেখিয়ে দে। তোকে তো খুব পছন্দ মালাকার দের 
নন্দ র। যাবি ‘’। শুনলাম তোকে  তো একদিন আটকেছিল।  পেমসায়ের থেকে চান করে উঠে আসার সময়। ভিজে গায়েই না কি জড়িয়ে ধরেছিল! তো যাবি তো বল!  সন্ধ্যে বেলায় তাঁতি বাগানের ধারে আমি থাকব। ‘’
মুখে কাপড় চাপা দিয়ে ছুটে পালিয়ে এসেছে ঘরে। বিছানায় উপুড় হয়ে কেঁদেছে। আবার আমগাছের আড়ালে  ভেজা গায়ে তাকে নন্দ র জড়িয়ে ধরা মনে পড়েছে। বুকে চিনচিনে ব্যথা ধরে গিয়েছিল। 
কতদিন গোপনে ছেলে হবার জন্যে জড়িবুটি র ওষুধ খেয়েছে তমালতলীর বুড়ি মাতামার কাছে। 
“ মাতামা বলেছিল, তোর দোষ না তোর মরদের দোষ “!  আরও অনেক কথা জিজ্ঞেস করেছিল মাতামা। সে উত্তর দিতে পারেনি লজ্জায়। 
কি দাম এ জীবনের। অনেক ভেবেছে সে। অনেক। এই তো নারীজীবন। 
একবার ভেবেছিল যাবে, ঐ কাপালিকের কাছে। 
কিন্তু প্রথমে সাহস হয়নি। ঐ নির্জনে। কাকে নিয়ে যাবে!  কাপালিক যদি ক্ষেপে যায়। শুনেছে মেয়ে দেখলে তার চোখ দুটো আগুনের গোলার মতো হয়ে যায়। সামনে ধুনি জ্বলছে। একপাশে ত্রিশূল গোঁজা মাটিতে। গলায় হাড়ের মালা। একটা নরমুণ্ডের খুলিতে ধুনো জ্বলছে। সে না কি সব খায়। বসুধা থেকে আর এক কাপালিক তাঁর সাথে মাঝে মাঝে দেখা করতে আসে। নিশ্চয়ই কাজের কথা থাকে। কিন্তু কি সে কাজের কথা কেউ জানেনা। বৃদ্ধ নদী তে চণ্ডাল রা মরা পোড়ায়। 
ডিঙি নৌকো পারাপার করে। তাহলে কি কাপালিক কে সেখানে যেতে হবে! মাল দের বলে রেখেছে। খবর দিতে। 
 তাও একদিন, অনেক সাহস সঞ্চয় করে, পাড়ার সম্পর্কে দেওর পাগলা দুলাল কে সাথে নিয়ে যাবার কথা ভাবলো। দুলাল পাগলা বটে কিন্তু মনটি খুব ভালো। সে তার বৌদি র মনের দুঃখ বোঝে। সে জানে বৌদির বর ঘরে থাকেনা। সন্ধ্যে হলেই বেরিয়ে যায়। সারা রাতে ফেরেনা। মদ আর মেয়ে এই তার নেশা। দেদার ফূর্তি ওড়ায়। 
তবু একদিন কাপালিকের কুঁড়েতে গেল। দুলাল কে সাথে নিয়ে। সাধারণত তাঁর কাছ কেউ ঘেঁসেনা। 
ওদিক মাড়ায়না। 
‘’ তোদের সাহস তো কম নয় ‘’। আমার কাছে এসেছিস! ‘’ 
হতভাগিনী সেই নারী পারুলকে কিছুই বলতে হলনা। 
কাপালিক এক এক করে সব বলে গেলেন। 
সে যা বলতে গিয়েছিল। তার মুখ থেকে কোন কথা বের হলনা। 
“ তুই তো আমার অনেক কাছে চলে এসেছিস “। 
আর কটা দিন। অমাবস্যা সামনেই। মুক্তি পেয়ে যাবি। তোর মুক্তি তে আমারও মুক্তি হবে রে মা “
যা আজ ঘরে যা। সবাই কে অবাক করে দিয়ে 
কাপালিক তাকে প্রণাম করে,  মা, মা, করে গগনবিদারী আওয়াজ করতে লাগলো। আর তার সাথে শুরু হল তার উন্মাদ নৃত্য। 
এরা নড়তেও পারছেনা। ভয়ে কেমন গুটিয়ে গেছে। মনে হল যেন কোন অদৃশ্য শক্তি তাকে জড়িয়ে  বেঁধে ফেলেছে। সে নড়তে পারছেনা। 
কিছুক্ষণ পরে কাপালিক বলে উঠলো “ যা, ঘরে যা। এই কটা দিন কাটা। শুদ্ধ ভাবে কাটাবি। অবশ্য স্বামীসংসর্গ তোর নাই। “ শরীর ঠিক আছে তো। “ 
কোন রকমে বাড়ি ফিরে এলো ওরা। কারও মুখে কোন কথা নাই। এই কদিন কারও সাথে কোন কথা বলেনি সে। 
তারপর এলো সেই দিন। ধীর পায়ে সন্ধ্যা নামছে। 
নিজের হাতেই নিজের জীবন বিসর্জন দিল সেই নারী। সেই বেনে বৌ। পারুল।
সে যেন কোন অদৃশ্য টানে। তার মন যেন শূন্য। 
মনে কোন চিন্তা, দ্বিধা দ্বন্দ্ব কিছুই নাই। শরীর টা থেকেও যেন নাই। এ শরীর কার। সে বুঝতে পারলনা কিছুই। 
কাপালিক ঝোপের আড়াল থেকে সবই দেখছিলেন। একবার, ক্ষণিকের জন্য হলেও তার মনে হল একে বাঁচানো যায়। না কাপালিকের মনে
দূর্বলতার স্থান নাই। তার নারীর শবদেহ চাই। 
তার সাধনার বাকী অংশটুকু আজই শেষ করতে হবে। আজ মহা অমাবস্যা। 
তারপর 
গাছ থেকে সাবধানে সেই নারী শবদেহ নামিয়ে 
কাঁধে তুলে নিয়ে এলো তার কুঁড়েতে।
গাছের ডালে বাঁধা থাকল তার শাড়ী র আঁচল। 
নিজেকে তৈরী করে নিল কাপালিক। 
তারপর নারী শবদেহের উপরে পদ্মাসনে বসে সারারাত চলল তার সাধনা। 
সকালে মানুষ জন এসে দেখল। কেউ কোথাও নেই। না কাপালিক। না সেই নারীর শবদেহ। 
------------ ------------ ------------ ------------

* চিত্র। অজয় তীরের এক স্থান। ঠিক সেই এলাকার ছবি নয়।

*কমেন্ট সেকশনে আমাকে ফেবারিট করার যে টেকনিক্যাল পদ্ধতি তা দেওয়া আছে।

** যাঁরা পড়েননি বা পাননি তাঁদের জন্য আবারও ফিরিয়ে দিলাম। এই সময় কালে অনেক নতুন বন্ধু যুক্ত হয়েছেন। পড়ুন। 
#allfollowerseveryone

No comments:

Post a Comment