Friday, 17 January 2025

নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের ৪৬ তম কুলগুরু শ্রী জয়দেব গোস্বামী

।।   সম্প্রদায়ের ৪৬ তমনিম্বার্ক কুলগুরু ঃ  স্রী জয়দেব গোস্বামী।।

মধুরকান্তপদাবলী, গীতগোবিন্দম এর রচয়িতা কবিবর
শ্রী জয়দেব গোস্বামী, নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের এক শাখার আচার্য্য কুলগুরু, হিসাবে পরিগণিত হয়েছিলেন।
নিম্বার্ক সম্প্রদায় কে প্রাচীণতম বৈষ্ণব সম্প্রদায় বলা যেতে পারে এই কারণে যে ৭ ম শতাব্দী তে এর উদ্ভব। সময়কাল নিয়ে যদিও  বিতর্ক আছে। অনেকে ১২ শতাব্দীর বলেছেন। কেউ ভুলবশতই ১৩ শতকের বলেছেন। অধিকাংশ পণ্ডিতের মতানুযায়ী নিম্বার্ক সম্প্রদায়ই প্রাচীণতম বৈষ্ণব সম্প্রদায়।
সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা  নিম্বাকাচার্য ছিলেন তেলেগুভাষী,
যোগী, দার্শনিক, জ্যোতিষী ।
তিনি বৈদূর্যপট্টনম বা বর্তমানের মুঙ্গি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বর্তমান পূর্ব মহারাষ্ট্রে।
পিতামাতার নামও পাওয়া যায় পিতা - অরুন  ঋষি, মাতা জয়ন্তী দেবী
তাঁরা সপরিবারে মথুরায় আগমন করেন এবং সেখানেই নিম্ববনে  বসতি স্থাপন করেন। মথুরা - বৃন্দাবনের বৈষ্ণবীয় আধ্যাত্মিক পরিমন্ডলে ই  নিম্বার্ক স্বামীর আধ্যাত্মিক চেতনা লাভ। এবং দ্বৈত - অদ্বৈত ( dualistic non dualism) মতবাদ প্রচার। তাঁর অনুগামীরা ই হলেন নিম্বার্ক সম্প্রদায়।
এর আরও নাম আছে  হংস সম্প্রদায়, সনকাদি, কুমার, হামসা। শ্রী হংসনারায়ন কে এঁরা প্রবর্তক হিসাবে গন্য করেন।
হংস ভগবান, সনকা / সানাকা,  সানন্দন, সনাতন, সনৎ কুমার এঁরা ই  চার কুমার। এঁরাই হচ্ছেন সম্প্রদায়ের পূর্বসুরী।
বৈষ্ণবধর্মের  যে চারটি ধারা,  ব্রহ্ম সম্প্রদায় - আচার্য মাধবাচার্য, লক্ষ্মীসম্প্রদায় - আচার্য রামানুজ, কুমার সম্প্রদায় - আচার্য নিম্বার্ক,  এবং রুদ্র বা শিব সম্প্রদায়ের বিষ্ণুস্বামী /শুদ্ধ দ্বৈতাচার্য।
যুগল সাধনা এই সম্প্রদায়ের প্রধান সাধনরীতি। রাধা কে কৃষ্ণের থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন করা যায়না। রাধা কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। যে কৃষ্ণ বিশ্বকে মন্ত্রমুগ্ধ,  মোহিত করেন, সেই কৃষ্ণকে রাধা যিনি তাঁর প্রেম মায়া দিয়ে কৃষ্ণকে নিয়ন্ত্রণ করেন। রাধা তাঁকেও মন্ত্রমুগ্ধ করেন। অতএব তিনি পরম দেবী। আরাধ্যা।
শ্রী কৃষ্ণ ই সুখস্বরূপ। রাধা তাঁর অবিচ্ছেদ্য অংশ। হ্লাদিনী শক্তি। রাধা কৃষ্ণ মাধুর্য আস্বাদনেই সুখ পান। উভয়েই তখন
একত্রে চিত্তসুখ ভোগ করেন।
এঁদের ধ্বনিনামগানে তাই " রাধে কৃষ্ণ রাধেকৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ রাধে রাধে। রাধে শ্যাম রাধেশ্যাম, শ্যাম শ্যাম রাধে রাধে।। "

আমাদের কবি  জয়দেব কবিকে  বোধহয় কোন সম্প্রদায়ের গণ্ডীর মধ্যে বাঁধা যায়না। তিনি সকলের। আউল, বাউল, সাঁই
সতুয়া, সকলের। তিনি যোগী, কায়াসাধক, পঞ্চোপাসক, নাথ যোগী, সহজ সাধক।

বুদ্ধকে তিনি দশাবতারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করলেন।
কথিত আছে যে যৌবনে তিনি অজয়ের ওপারে, দক্ষিণে
বিদবিহারের বৌদ্ধ মঠে সাধনার জন্য যেতেন। সাধনার জন্য সেনপাহাড়ী তে যেতেন। আসলে তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক মার্গের এক পরিব্রাজক।
তিনি " পদ্মাবতী চরণ চারণ চক্রবর্তী "
" কেন্দুবিল্ব সমুদ্রসম্ভব রোহিনী রমন "
তিনি " আধুনিক আর্যভাষার আদিকবি "
" বাঙলার কবি, জয়দেব কবি কান্ত কোমল পদে
করেছো সুরভি সংস্কৃতের কাঞ্চনককোনদে। "
  " যদি হরিস্মরনে সরসং মনঃ
যদি বিলাসকলাসু  কুতুহলম
মধুরকোমলকান্ত পদাবলীং
শৃণু তথা জয়দেব সরস্বতীম।।

কবি জয়দেব প্রৌঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্তে বৈষ্ণব তীর্থ বৃন্দাবনে চলে
গেলেন। একজন বৈষ্ণবের পক্ষে বৃন্দাবনের প্রতি আকর্ষণ স্বাভাবিক। যদিও কবির বৃন্দাবন জীবন নিয়ে বিস্তৃত কিছু জানা যায়না। তবুও তিনি যে সেখানেই নিম্বার্ক সম্প্রদায়ে যোগ দান করলেন এমন অনুমান অসঙ্গত হবেনা। গভীর সাধন মার্গে প্রবেশ করে ধীরে তিনি সম্প্রদায়ের এক জন আচার্য্য হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। এই সম্প্রদায়ের সাধন মার্গের সাথে, তার দর্শনের সাথে, যুগল সাধনার মধ্যে তিনি
নিজের প্রার্থিত পথের সন্ধান পেয়েছিলেন। ক্রমে তিনি হলেন
এই বৃন্দাবনের টাট্টিস্থানের নিম্বার্ক সম্প্রদায় এর এক শাখার
৪৬ তম কুলগুরু।
বৃন্দাবনেই তিনি অত্যন্ত পরিণত বয়সে দেহত্যাগ করেন।
সেখানের টাট্টিস্থান আশ্রমে তাঁর সমাধি আছে।
পদ্মাবতী র কোন সংবাদ পাওয়া যায়না। নিশ্চিত ভাবেই তিনি বিসর্জিতা হননি। কেননা জয়দেবের তিনি যে সাধন সঙ্গিনী।
অনেক উচ্চে তিনি রাধা কে স্থান দিয়েছেন। সময়ের প্রেক্ষিতে
যা অভাবনীয়। তাই তাঁর অন্তরের অন্তস্তল থেকে উৎসারিত হয়েছে " স্মরগরল খণ্ডনং মম শিরসী মণ্ডনং, দেহি পদ পল্লব
মুদারম "। তিনি কি পদ্মাবতী কে ত্যাগ করতে পারেন।
  তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে এই সম্প্রদায়ের এক গোস্বামী
রাধারমণ ব্রজবাসী তাঁদের কুলগুরু জয়দেবের জন্মস্থানের
খোঁজে এই বাঙ্গলায় আসেন। বর্ধমানের রাজপরিবারের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন  অজয়ের তীরে কেন্দুবিল্ব গ্রামই
কবি জয়দেব গোস্বামীর জন্মস্থান। ইতিমধ্যেই রাজপরিবারের
পক্ষে রাজা কীর্তি চাঁদ জননী ব্রজকিশোরী দেবীর নির্দেশে
জয়দেব কেন্দুলী তে বিরাট রাধাবিনোদ মন্দির নির্মিত হয়েছে। সাল - ১৬০৫ শকাব্দে, বীরভূম জেলা গেজেটিয়ার অনুযায়ী। অন্য মতে ১৬৯৪/৯৬ সালে   ৷ কথিত যে জয়দেবের অভিজনদের বাস্তুভিটার উপরেই
এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল। বিরাট নবরত্ন মন্দির। এবং অসাধারণ তার টেরাকোটা অলংকরণ। আজও মন্দিরের অভ্যন্তরে পশ্চিম দিকের এক ছোট্ট কুঠুরি কে জয়দেবের জন্মস্থল বলে মনে করা হয়।
রাধারমণ ব্রজবাসী এখানেই থেকে আশ্রম, বা আখড়া বা মঠ স্থাপন  করার বাসনা প্রকাশ করায় বর্ধমানের রাজা ত্রিলোক চন্দ্র  রাজ এস্টেট থেকে অনেক জমিজায়গা দান সহ বার্ষিক
ভোগ, সেবা, অন্নসেবা  দানের জন্য নগদ টাকা মঞ্জুর
করেন। বর্তমান যা মোহান্ত অস্থল নামে পরিচিত। অস্থল এই অভিধা অনেক পরের। শুরুতে আখড়া বা আশ্রম পরে মঠ।
রাধারমণ ব্রজবাসী ছিলেন একজন সাধক। পরিণত বয়সে
ভূ-গর্ভস্থ সমাধি গহ্বরে  ধ্যানমগ্ন অবস্থায় প্রাণত্যাগ করেন।
পরবর্তী সময়ে  মোহান্ত হন দামোদর চন্দ্র ব্রজবাসী। তিনি এক বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। ঘোড়ার পিঠে চেপে জমি জায়গার তদারকি করতেন। চাষি দের কাছ থেকে যাতে  ন্যাহ্য ফসল আদায় হয় সেদিকে তাঁর প্রখর দৃষ্টি ছিল। একাধারে প্রায় জমিদার, আবার মোহান্ত। তাঁর সম্পর্কে নানা মত আছে। কেউ বলেন তিনি ছিলেন অত্যাচারী। কেউ বলেন গোপনে ইংরেজ দের বিরুদ্ধে প্রচার করতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী দের সাহায্য করতেন। হাতে বন্দুক নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে এলাকা পরিক্রমা করতেন। স্থানীয় অনেক ভূস্বামী র সাথে তাঁর বিরোধ ছিল ।  দুর্বৃত্ত দলের হাতে নদীগর্ভে তিনি
নিহত হন। সে ও এক রহস্য। সেই সময়ের এক আলোড়ন সৃষ্টি কারী ঘটনা।।
দামোদর চন্দ্রের শবদেহ দাহ করা হয়েছিল কদমখণ্ডী শ্মশানে। অস্থি সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
দামোদর চন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত কর্মদক্ষ ব্যক্তি। গ্রামের উন্নতি তে তিনি  মনোযোগ দিয়েছিলেন। রাস্তা ঘাটের উন্নতি, পুষ্করিণী খণন, ইত্যাদি কাজ তিনি করিয়েছিলেন। গ্রামে ডাকঘর তাঁর আমলেই স্থাপিত হয়। আশ্রমের আর্থিক অবস্থার প্রভূত উন্নতি তাঁর সময়ে হয়েছিল। এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের তিনি ছিলেন পৃষ্ঠ পোষক।
অত্যন্ত অল্পবয়সে পরবর্তী মোহান্ত হন শ্রী রাসবিহারী শরণদেব ব্রজবাসী। তাঁর পক্ষে আশ্রম পরিচালনা করতেন
উখরা আশমের ব্রজভূষণ শরণদেব এবং হলধর শরণদেব মোহান্ধ। সাবালকত্ব প্রাপ্তি র পর আশ্রমের দায়িত্বভার তিনি নিজ স্কন্ধে গ্রহন করেন। স্বচেষ্টায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত। তিনি যেমন ছিলেন সংস্কতজ্ঞ পণ্ডিত, তেমনি ছিলেন নিষ্কাম, উদার মনের, সাধু প্রকৃতির ব্যক্তি।
তিনি কিন্তু " তালুকদার মোহান্ত " ছিলেন। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তার ভীষণ আগ্রহ ছিল। " রাজরাজেশ্বর অপেরা"
নামে এক যাত্রা দল গঠন করেন। তাঁর সময়ে শ্রী রাধাবল্লভ
তপস্বী নামে এক সংস্কৃত পণ্ডিত দীর্ঘকাল আশ্রমে বসবাস করে গীতগোবিন্দম পাঠ , ভাগবত, এবং অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ
পাঠ, এবং ব্যাখ্যা করতেন।
সংক্রান্তির দিন ভোরে শোভাযাত্রা করে তিনি অজয়ে স্নানের ঘাটে যেতেন। পিছনে যেত নাম গানের দল।
তিনি স্নান করার পর স্নানযাত্রায় আগত ভক্তগন স্নান করতেন।
ফুলচাঁদ ব্রজবাসী ঃ  পূর্ববর্তী মোহান্ধ হীরালাল ব্রজবাসী র প্রধান চেলা বা শিষ্য ছিলেন এই ফুলচাঁদ ব্রজবাসী । ১২৬০ বঙ্গাব্দে তিনি গদিয়ান হন।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত কর্মদক্ষ ব্যক্তি। তাঁর আমলে মোহান্ত অস্থলের প্রভূত উন্নতি হয়। সেনপাহাড়ী এবং সেনভূম পরগনার  বহু পত্তনি এবং দরপত্তনির তালুক বা তালিকের অংশ তিনি ক্রয় করেন। কেন্দুলীর তালুকদার ছিলেন জনুবাজার গ্রামের দত্ত বাড়ি। পরবর্তী সময়ে তিনি কেন্দুলী র তালুক সহ নীলামে পত্তনি তালুক জনুবাজার ও খরিদ করে নেন। একজন নিষ্ঠাবান এবং দরদী মোহান্ত ছিলেন এই ভরতচন্দ্র। তাঁর সময়কাল কেন্দুলীর মোহান্ত অস্থল এর
এক গৌরব ময় সময়।
ফুলচাঁদ ব্রজবাসী নিজে আশ্রম মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন।
মন্দিরের পূজারী ছিলেন যোগেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
আশ্রমে সারা বৎসর পালিত হত নানা ব্রত, উৎসব।
এই সকল ব্রত উৎসবে পুরোহিতের কাজ করতেন লক্ষ্মীনারায়ণ গোস্বামী। শ্রী রামপুর পটির বিখ্যাত পণ্ডিত ঈশ্বর সিদ্ধান্ত আচার্য্য র সাথে ছিল তার গভীর সখ্য।
প্রায় প্রতিদিন ই তাঁদের দেখা সাক্ষাৎ, আলাপ আলোচনা হত।
এই ব্রজবাসী ফুলচাঁদের সময়েই নির্মিত হয় জয়দেব কেন্দুলী র বিখ্যাত পিতলের রথ।
নবরত্ন রাধাবিনোদ  মন্দিরের অনুকরণে নির্মিত হয় বৃহদাকার
পিতলের রথ টি। ১২৯৬  থেকে ১২৯৮ পর্যন্ত এর নির্মানকাজ চলে। এই রথের প্রধান নির্মাতা ছিলেন কেন্দুলীর পশ্চিমে
টিকরবেতা গ্রামের শ্রী বনমালী মণ্ডল।
অন্যান্য যাঁরা এই নির্মান কার্যে যুক্ত ছিলেন তাঁরা হলেন
টিকরবেতা গ্রামের - ক্ষুদিরাম কর্মকার,  ঈশ্বরচন্দ্র কর্মকার, প্রতাপচন্দ্র কর্মকার, বঙ্কুবিহারী কর্মকার, কাঙাল দাস বৈরাগ্য
এবং নবীন হাঁড়ি ।
দুবরাজপুরের -  গণেশ কবিরাজ, রামেশ্বর দাসবৈরাগ্য, ঈশ্বর দাস বৈরাগ্য, পশুপতি দাস বৈরাগ্য।
ভিরিঙ্গি গ্রামের - গণেশ কর্মকার
প্রতাপপুরের - ননীতালাল কর্মকার
কাঁটাবেড়ে গ্রামের - নিকুঞ্জ কর্মকার
" হিসাবের খাতায় দেখা যায় ১২৯৬-৯৭ বঙ্গাব্দে রথ নির্মানের শিল্পী দের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছে প্রায় ১৫০০ / টাকা।
সহজেই অনুমান করা যায় কি বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়িত হয়েছিল সেই বৃহদাকার রথ নির্মানে।
রথ নির্মানের পর এই ফুলচাঁদ ব্রজবাসীর সময় থেকেই কেন্দুলী বিখ্যাত রথযাত্রা উৎসব এর শুরু হয়।
তাছাড়াও রাসউৎসব, দোলউৎসব, এর ও আয়োজন হত।
রামায়ন গান, ভাগবত পাঠ, কৃষ্ণযাত্রা ও অনুষ্ঠিত হত আশ্রমে।
এখানে উল্লেখ্য বিখ্যাত সাধক কবি নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায় তাঁর কৃষ্ণযাত্রার দল নিয়ে পালা গান পরিবেশন করতেন।
সেই আসরে রামপুরের ঈশ্বর সিদ্ধান্ত আচার্য্য মহাশয়ের উপস্থিতি ছিল একান্ত কাম্য। তাঁর সাথে সাধক নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায়ের বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। তিনি আসরে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত কণ্ঠ মশাই গানই শুরু করতেন না।
পিতলের রথের কারুকার্য ---  অসামান্য এর গঠন। নির্মান শৈলী। রূপদক্ষ শিল্পী দের হাতে ফুটে উঠেছে অসামান্য সব
সারল্য ভরা চিত্র। হয়তো ড্রইং - এ সেই দক্ষতা নেই। কিন্তু
শিল্পীরা খোদাই করেছেন মনের আনন্দে। কিন্তু নারীমুখে এসেছে বিষাদ। আছে নগ্নিকারা। প্রশ্ন জাগে এত নগ্নতা কেন!
  সেখানে কি গীতগোবিন্দের বিকৃত প্রভাব! না কি সমাজ চিত্রণ!
ফুলচাঁদ ব্রজবাসী র সময় থেকেই কেন্দুলী তে রথযাত্রা উৎসব
শুরু হয়।  উৎসাহ উদ্দীপনায় রথ কেন্দুলী র পথ পরিক্রমা করে।
দীর্ঘ দিন এই উৎসব চালু থাকার পর নানাবিধ কারনে রথযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। রথ টি ভেঙে ছোট করার প্রয়োজনে রথ টি কে ভাঙা শুরু হতেই জনমানসে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ভীষণ গোলযোগ সৃষ্টি হয়।
যাক শেষ পর্যন্ত রথটিকে আবার মোটামুটি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। তবে অলংকৃত অনেক প্লেট হারিয়ে বা চুরি হয়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত গতবৎসর ; প্রায় পঞ্চাশ বছর পর আবার সেই রথ
বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে জয়দেব কেন্দুলী র পথে নামে। এই রথযাত্রা উপলক্ষ্যে বিশাল জনসমাবেশ ঘটেছিল।
মোহান্ত অস্থল ; তাঁদের সহযোগীগন ; জয়দেব কেন্দুলী সেবা ও সংস্কৃতি সমিতি ; সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ' ভক্তি ভবন ' এর
সদস্য গনের সক্রিয় সহযোগিতায় ঐতিহ্য মণ্ডিত  রথযাত্রা উৎসব জয়দেব কেন্দুলী তে পুনরায় চালু হয়।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------
এই প্রবন্ধে পূর্বাপর সকল ব্রজবাসী মোহান্ত র নাম বা তাঁদের কার্যকাল সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়নি।
সংক্ষেপে -  রাধারমণ ব্রজবাসী কেই প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে গন্য করা হয়। বর্ধমানের রাজা ত্রিলোকচন্দ্রের আমলেই কেন্দুলী র নিম্বার্ক আশ্রমের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল দ্বাদশ বঙ্গাব্দের
ষষ্ঠ অথবা সপ্তম শতকে।

যদিও বর্ধমান রাজবাড়ির দেওয়ানের দপ্তর থেকে এক  পত্র মারফত বৃন্দাবন থেকে আগত  রাধামোহন ব্রজবাসী নামক
এক সাধু প্রকৃতি র ব্যক্তি কে বেশ কিছু জমি জায়গা, এবং নগদ ৩৬১ / টাকা প্রদান করা হয়। ১১৬২ বঙ্গাব্দে ২১ শে মাঘ।  তিনি কেন্দুবিল্বে বসবাস করে সেনপাহাড়ী এবং সেনভূম, শেরগড়, সিলামপুর প্রভৃতি স্থানে
সদাসেবাব্রত পালনের ব্যবস্থা করতেন।
মনে হতে পারে তিনিই হয়তো কেন্দুলীর মোহান্ত অস্থল এর প্রতিষ্ঠাতা। বিশিষ্ট ওড়িয়া গবেষক বনমালী রথ তাঁকেই
গদির প্রতিষ্ঠাতা বলে উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু তাঁর নামের আগে ' সেবাইত '  গোস্বামী, বা মোহান্ত
কোন কথারই উল্লেখ নাই।
ব্রজবাসী রাধামোহন  কেন্দুলীর নিম্বার্ক আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা না হলেও এখানে আশ্রম স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে
তিনি তার ক্ষেত্র রচনা করেছিলেন নিঃসন্দেহে। "
রাজা ত্রিলোক চন্দ্রের সময়ে দ্বিতীয় একটি পত্রে দেখা যাচ্ছে
রাধারমণ ব্রজবাসী কে সেবাইত বলা হচ্ছে। তিনি যে আখড়া ধারী তাও বলা হচ্ছে। সেই জন্য রাধারমণ কেই প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়।
সমাধি ক্ষেত্রে  রাধারমণ ব্রজবাসী থেকে সর্বেশ্বর ব্রজবাসী পর্যন্ত সাতজন গোস্বামী র সমাধি রয়েছে। অন্য কারোর নয়।
হয়তো তাঁরা এখানে দেহত্যাগ করেন নি। বা বৈষ্ণবীয় ধারায়
প্রতিষ্ঠাতা হলে বা আখড়া ধারী সেবাইত হলে তাঁরই সমাধি
সমাধিস্থলে থাকে। এমনকি রাধারমন ব্রজবাসীর গুরু
ভরদ্বাজ মহান্তের ও সমাধি এখানে নাই। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------
ব্রজবাসী  আশ্রম ধারী পূর্বসুরীসাত গোস্বামী র নাম যাঁদের
সমাধি রয়েছে, সমাধি ক্ষেত্রে ------------
১) রাধারমণ ব্রজবাসী  ২) ভরতচন্দ্র  ৩) প্যারীচরণ ৪) হীরালাল ৫) ফুলচাঁদ ৬)রামগোপাল ৭) সর্বেশ্বর
( সকলেই ব্রজবাসী) 

সর্বেশ্বর এর পর মোহান্ত হয়েছিলেন  দামোদর চন্দ্র ব্রজবাসী।
তারপর রাসবিহারী ব্রজবাসী। হরিকান্ত শরণদেব কে স্বেচ্ছায়
মোহান্ত পদ ছেড়ে দেন রাসবিহারী ব্রজবাসী।
" পত্তনি তালুক দার মোহান্ত ' বলে কেন্দুলী র মোহান্ত গণ
নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন বিভিন্ন কাগজপত্রে। অর্থাৎ তাঁরা
একাধারে ছিলেন ধর্মজগতের মানুষ, আবার অন্যদিকে ছিলেন বিষয় জগতের মানুষ। বিষয় বাসনা কে পরিহার করেই
প্রবেশ করতে হয় ধর্মজগতে। তাই ধর্ম ও বিষয় পরস্পর বিরুদ্ধ এই দু ' য়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা সুকঠিন। কেন্দুলী র কোন কোন মহান্তের পক্ষে সেই সামঞ্জস্য বিধান করা সম্ভব হয়নি। আশ্রম পরিচালনার জন্য আয়ের উৎস স্বরূপ কিছু কিছু দেবোত্তর জমি জায়গা হয়তো থাকা দরকার-কিন্তু অগাধ ধনসম্পদের কোন প্রয়োজন হতে পারেনা।জানা যায় দেবতার নামে বিষয় সম্পত্তি উত্তোরত্তর
বাড়িয়ে চলা যেন নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল দু - এক জন মহান্তের
তাই স্বাভাবিক বিষয় বিষে বিষিয়ে গিয়েছিল তাঁদের পবিত্র
সাধক জীবন - তাঁদের আমলে অবাঞ্ছনীয় হীণ কার্যকলাপে
কলুষিত হয়েছিল পবিত্র আশ্রম। "
বর্তমানে আশ্রমের আয় খুবই সীমিত। জমি জায়গা সব বেদখল হয়ে গেছে। উৎপন্ন শস্যের ভাগ চাষি দের কাছ থেকে আশ্রমে আসেনা।
তারই মধ্যে আশ্রম পরিচালনা করতে হয়। কেন্দুলীর নিম্বার্ক আশ্রম কে রাজরাজেশ্বর মঠও বলা হয়। কারণ শ্রী শ্রী রাজরাজেশ্বর ই এই আশ্রমের মূল দেবতা। তিনি শালগ্রাম শিলায় পূজিত হন। রাধারমণ ব্রজবাসী ই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন
এই শালগ্রাম শিলা। পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন নানা
দেবদেবী। চৈতন্য মহাপ্রভু ও গৃহীত হয়েছেন সমাদরে।
  কেন্দুলীর  মোহান্ত আশ্রম নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের হলেও এখানে পূজিত নানা দেবদেবীর অধিষ্ঠান দেখে বোঝা যায় --- রামাইত, মধ্বাচার্য, বল্লভী, গৌড়ীয় ইত্যাদি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বৈষ্ণব ধর্মের মিলনক্ষেত্র কেন্দুলীর এই মোহান্ত আশ্রম।
পৌষসংক্রান্তির অজয়ে স্নানের জমায়েত কে নদী গর্ভ থেকে তুলে এনে ডাঙা য় বা মোহান্ত আশ্রমের সামনের রাস্তার দুপাশে
মেলা বসিয়েছিলেন এঁরাই। মেলার সময় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বৈষ্ণব রা দেশের নানা স্থান থেকে এসে এখানে আশ্রয় নিতেন।
   বর্তমানে সেই সমাবেশ না হলেও আশ্রম পরিচালনা করার
আন্তরিক প্রয়াস রয়েছে বর্তমান ব্রজবাসী সহ সহযোগী  আশ্রম পরিচালক দের।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ সমাপ্ত।
গ্রন্থ ঋণ।  জয়দেব কেন্দুলী র মোহান্ত আশ্রম। ড‌′• অজিত কুমার দাস।
জেলা গেজেটিয়ার। বীরভূম। ও ' ম্যালি
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা লাইন।
গীতগোবিন্দম । সাহিত্য রত্ন হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়
নেট মাধ্যম। উইকিপিডিয়া।
চিত্র ঋণ। পুরাতন রথের ছবি ( সাদা কালো ছবি)
মুকুল দে আর্কাইভ থেকে। সত্যশ্রী উকিল এর সৌজন্যে প্রাপ্ত।
শিবের বিবাহ সহ কয়েকটি প্লেটের ছবি।
------------- ------------ ------------ ------------ ------------ 
** লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সরকারি উদ্যোগের 
" বাউল তীর্থ পত্রিকা য় "। আজ ছিল  মেলার উদ্বোধনী  দিন।আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম।  সেখানেই পত্রিকা প্রকাশিত হল। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ 
মোহান্ত অস্থল এর প্রাচীণ রথের ছবি। 
মূল ছবি। মুকুল দে আর্কাইভ থেকে। সত্যশ্রী উকিল দা র সৌজন্যে প্রাপ্ত। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------

Monday, 13 January 2025

জয়দেব কেন্দুলীর মোহান্ত অস্থল। ৪৬ তম কুলগুরু জয়দেব।

।।  নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের ৪৬ তম কুলগুরু ঃ  স্রী জয়দেব গোস্বামী।।

মধুরকান্তপদাবলী, গীতগোবিন্দম এর রচয়িতা কবিবর
শ্রী জয়দেব গোস্বামী, নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের এক শাখার আচার্য্য কুলগুরু, হিসাবে পরিগণিত হয়েছিলেন।
নিম্বার্ক সম্প্রদায় কে প্রাচীণতম বৈষ্ণব সম্প্রদায় বলা যেতে পারে এই কারণে যে ৭ ম শতাব্দী তে এর উদ্ভব। সময়কাল নিয়ে যদিও  বিতর্ক আছে। অনেকে ১২ শতাব্দীর বলেছেন। কেউ ভুলবশতই ১৩ শতকের বলেছেন। অধিকাংশ পণ্ডিতের মতানুযায়ী নিম্বার্ক সম্প্রদায়ই প্রাচীণতম বৈষ্ণব সম্প্রদায়।
সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা  নিম্বাকাচার্য ছিলেন তেলেগুভাষী,
যোগী, দার্শনিক, জ্যোতিষী ।
তিনি বৈদূর্যপট্টনম বা বর্তমানের মুঙ্গি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বর্তমান পূর্ব মহারাষ্ট্রে।
পিতামাতার নামও পাওয়া যায় পিতা - অরুন  ঋষি, মাতা জয়ন্তী দেবী
তাঁরা সপরিবারে মথুরায় আগমন করেন এবং সেখানেই নিম্ববনে  বসতি স্থাপন করেন। মথুরা - বৃন্দাবনের বৈষ্ণবীয় আধ্যাত্মিক পরিমন্ডলে ই  নিম্বার্ক স্বামীর আধ্যাত্মিক চেতনা লাভ। এবং দ্বৈত - অদ্বৈত ( dualistic non dualism) মতবাদ প্রচার। তাঁর অনুগামীরা ই হলেন নিম্বার্ক সম্প্রদায়।
এর আরও নাম আছে  হংস সম্প্রদায়, সনকাদি, কুমার, হামসা। শ্রী হংসনারায়ন কে এঁরা প্রবর্তক হিসাবে গন্য করেন।
হংস ভগবান, সনকা / সানাকা,  সানন্দন, সনাতন, সনৎ কুমার এঁরা ই  চার কুমার। এঁরাই হচ্ছেন সম্প্রদায়ের পূর্বসুরী।
বৈষ্ণবধর্মের  যে চারটি ধারা,  ব্রহ্ম সম্প্রদায় - আচার্য মাধবাচার্য, লক্ষ্মীসম্প্রদায় - আচার্য রামানুজ, কুমার সম্প্রদায় - আচার্য নিম্বার্ক,  এবং রুদ্র বা শিব সম্প্রদায়ের বিষ্ণুস্বামী /শুদ্ধ দ্বৈতাচার্য।
যুগল সাধনা এই সম্প্রদায়ের প্রধান সাধনরীতি। রাধা কে কৃষ্ণের থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন করা যায়না। রাধা কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। যে কৃষ্ণ বিশ্বকে মন্ত্রমুগ্ধ,  মোহিত করেন, সেই কৃষ্ণকে রাধা যিনি তাঁর প্রেম মায়া দিয়ে কৃষ্ণকে নিয়ন্ত্রণ করেন। রাধা তাঁকেও মন্ত্রমুগ্ধ করেন। অতএব তিনি পরম দেবী। আরাধ্যা।
শ্রী কৃষ্ণ ই সুখস্বরূপ। রাধা তাঁর অবিচ্ছেদ্য অংশ। হ্লাদিনী শক্তি। রাধা কৃষ্ণ মাধুর্য আস্বাদনেই সুখ পান। উভয়েই তখন
একত্রে চিত্তসুখ ভোগ করেন।
এঁদের ধ্বনিনামগানে তাই " রাধে কৃষ্ণ রাধেকৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ রাধে রাধে। রাধে শ্যাম রাধেশ্যাম, শ্যাম শ্যাম রাধে রাধে।। "

আমাদের কবি  জয়দেব কবিকে  বোধহয় কোন সম্প্রদায়ের গণ্ডীর মধ্যে বাঁধা যায়না। তিনি সকলের। আউল, বাউল, সাঁই
সতুয়া, সকলের। তিনি যোগী, কায়াসাধক, পঞ্চোপাসক, নাথ যোগী, সহজ সাধক।

বুদ্ধকে তিনি দশাবতারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করলেন।
কথিত আছে যে যৌবনে তিনি অজয়ের ওপারে, দক্ষিণে
বিদবিহারের বৌদ্ধ মঠে সাধনার জন্য যেতেন। সাধনার জন্য সেনপাহাড়ী তে যেতেন। আসলে তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক মার্গের এক পরিব্রাজক।
তিনি " পদ্মাবতী চরণ চারণ চক্রবর্তী "
" কেন্দুবিল্ব সমুদ্রসম্ভব রোহিনী রমন "
তিনি " আধুনিক আর্যভাষার আদিকবি "
" বাঙলার কবি, জয়দেব কবি কান্ত কোমল পদে
করেছো সুরভি সংস্কৃতের কাঞ্চনককোনদে। "
  " যদি হরিস্মরনে সরসং মনঃ
যদি বিলাসকলাসু  কুতুহলম
মধুরকোমলকান্ত পদাবলীং
শৃণু তথা জয়দেব সরস্বতীম।।

কবি জয়দেব প্রৌঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্তে বৈষ্ণব তীর্থ বৃন্দাবনে চলে
গেলেন। একজন বৈষ্ণবের পক্ষে বৃন্দাবনের প্রতি আকর্ষণ স্বাভাবিক। যদিও কবির বৃন্দাবন জীবন নিয়ে বিস্তৃত কিছু জানা যায়না। তবুও তিনি যে সেখানেই নিম্বার্ক সম্প্রদায়ে যোগ দান করলেন এমন অনুমান অসঙ্গত হবেনা। গভীর সাধন মার্গে প্রবেশ করে ধীরে তিনি সম্প্রদায়ের এক জন আচার্য্য হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। এই সম্প্রদায়ের সাধন মার্গের সাথে, তার দর্শনের সাথে, যুগল সাধনার মধ্যে তিনি
নিজের প্রার্থিত পথের সন্ধান পেয়েছিলেন। ক্রমে তিনি হলেন
এই বৃন্দাবনের টাট্টিস্থানের নিম্বার্ক সম্প্রদায় এর এক শাখার
৪৬ তম কুলগুরু।
বৃন্দাবনেই তিনি অত্যন্ত পরিণত বয়সে দেহত্যাগ করেন।
সেখানের টাট্টিস্থান আশ্রমে তাঁর সমাধি আছে।
পদ্মাবতী র কোন সংবাদ পাওয়া যায়না। নিশ্চিত ভাবেই তিনি বিসর্জিতা হননি। কেননা জয়দেবের তিনি যে সাধন সঙ্গিনী।
অনেক উচ্চে তিনি রাধা কে স্থান দিয়েছেন। সময়ের প্রেক্ষিতে
যা অভাবনীয়। তাই তাঁর অন্তরের অন্তস্তল থেকে উৎসারিত হয়েছে " স্মরগরল খণ্ডনং মম শিরসী মণ্ডনং, দেহি পদ পল্লব
মুদারম "। তিনি কি পদ্মাবতী কে ত্যাগ করতে পারেন।
  তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে এই সম্প্রদায়ের এক গোস্বামী
রাধারমণ ব্রজবাসী তাঁদের কুলগুরু জয়দেবের জন্মস্থানের
খোঁজে এই বাঙ্গলায় আসেন। বর্ধমানের রাজপরিবারের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন  অজয়ের তীরে কেন্দুবিল্ব গ্রামই
কবি জয়দেব গোস্বামীর জন্মস্থান। ইতিমধ্যেই রাজপরিবারের
পক্ষে রাজা কীর্তি চাঁদ জননী ব্রজকিশোরী দেবীর নির্দেশে
জয়দেব কেন্দুলী তে বিরাট রাধাবিনোদ মন্দির নির্মিত হয়েছে। সাল - ১৬০৫ শকাব্দে, বীরভূম জেলা গেজেটিয়ার অনুযায়ী। অন্য মতে ১৬৯৪/৯৬ সালে   ৷ কথিত যে জয়দেবের অভিজনদের বাস্তুভিটার উপরেই
এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল। বিরাট নবরত্ন মন্দির। এবং অসাধারণ তার টেরাকোটা অলংকরণ। আজও মন্দিরের অভ্যন্তরে পশ্চিম দিকের এক ছোট্ট কুঠুরি কে জয়দেবের জন্মস্থল বলে মনে করা হয়।
রাধারমণ ব্রজবাসী এখানেই থেকে আশ্রম, বা আখড়া বা মঠ স্থাপন  করার বাসনা প্রকাশ করায় বর্ধমানের রাজা ত্রিলোক চন্দ্র  রাজ এস্টেট থেকে অনেক জমিজায়গা দান সহ বার্ষিক
ভোগ, সেবা, অন্নসেবা  দানের জন্য নগদ টাকা মঞ্জুর
করেন। বর্তমান যা মোহান্ত অস্থল নামে পরিচিত। অস্থল এই অভিধা অনেক পরের। শুরুতে আখড়া বা আশ্রম পরে মঠ।
রাধারমণ ব্রজবাসী ছিলেন একজন সাধক। পরিণত বয়সে
ভূ-গর্ভস্থ সমাধি গহ্বরে  ধ্যানমগ্ন অবস্থায় প্রাণত্যাগ করেন।
পরবর্তী সময়ে  মোহান্ত হন দামোদর চন্দ্র ব্রজবাসী। তিনি এক বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। ঘোড়ার পিঠে চেপে জমি জায়গার তদারকি করতেন। চাষি দের কাছ থেকে যাতে  ন্যাহ্য ফসল আদায় হয় সেদিকে তাঁর প্রখর দৃষ্টি ছিল। একাধারে প্রায় জমিদার, আবার মোহান্ত। তাঁর সম্পর্কে নানা মত আছে। কেউ বলেন তিনি ছিলেন অত্যাচারী। কেউ বলেন গোপনে ইংরেজ দের বিরুদ্ধে প্রচার করতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী দের সাহায্য করতেন। হাতে বন্দুক নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে এলাকা পরিক্রমা করতেন। স্থানীয় অনেক ভূস্বামী র সাথে তাঁর বিরোধ ছিল ।  দুর্বৃত্ত দলের হাতে নদীগর্ভে তিনি
নিহত হন। সে ও এক রহস্য। সেই সময়ের এক আলোড়ন সৃষ্টি কারী ঘটনা।।
দামোদর চন্দ্রের শবদেহ দাহ করা হয়েছিল কদমখণ্ডী শ্মশানে। অস্থি সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
দামোদর চন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত কর্মদক্ষ ব্যক্তি। গ্রামের উন্নতি তে তিনি  মনোযোগ দিয়েছিলেন। রাস্তা ঘাটের উন্নতি, পুষ্করিণী খণন, ইত্যাদি কাজ তিনি করিয়েছিলেন। গ্রামে ডাকঘর তাঁর আমলেই স্থাপিত হয়। আশ্রমের আর্থিক অবস্থার প্রভূত উন্নতি তাঁর সময়ে হয়েছিল। এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের তিনি ছিলেন পৃষ্ঠ পোষক।
অত্যন্ত অল্পবয়সে পরবর্তী মোহান্ত হন শ্রী রাসবিহারী শরণদেব ব্রজবাসী। তাঁর পক্ষে আশ্রম পরিচালনা করতেন
উখরা আশমের ব্রজভূষণ শরণদেব এবং হলধর শরণদেব মোহান্ধ। সাবালকত্ব প্রাপ্তি র পর আশ্রমের দায়িত্বভার তিনি নিজ স্কন্ধে গ্রহন করেন। স্বচেষ্টায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত। তিনি যেমন ছিলেন সংস্কতজ্ঞ পণ্ডিত, তেমনি ছিলেন নিষ্কাম, উদার মনের, সাধু প্রকৃতির ব্যক্তি।
তিনি কিন্তু " তালুকদার মোহান্ত " ছিলেন। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তার ভীষণ আগ্রহ ছিল। " রাজরাজেশ্বর অপেরা"
নামে এক যাত্রা দল গঠন করেন। তাঁর সময়ে শ্রী রাধাবল্লভ
তপস্বী নামে এক সংস্কৃত পণ্ডিত দীর্ঘকাল আশ্রমে বসবাস করে গীতগোবিন্দম পাঠ , ভাগবত, এবং অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ
পাঠ, এবং ব্যাখ্যা করতেন।
সংক্রান্তির দিন ভোরে শোভাযাত্রা করে তিনি অজয়ে স্নানের ঘাটে যেতেন। পিছনে যেত নাম গানের দল।
তিনি স্নান করার পর স্নানযাত্রায় আগত ভক্তগন স্নান করতেন।
ফুলচাঁদ ব্রজবাসী ঃ  পূর্ববর্তী মোহান্ধ হীরালাল ব্রজবাসী র প্রধান চেলা বা শিষ্য ছিলেন এই ফুলচাঁদ ব্রজবাসী । ১২৬০ বঙ্গাব্দে তিনি গদিয়ান হন।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত কর্মদক্ষ ব্যক্তি। তাঁর আমলে মোহান্ত অস্থলের প্রভূত উন্নতি হয়। সেনপাহাড়ী এবং সেনভূম পরগনার  বহু পত্তনি এবং দরপত্তনির তালুক বা তালিকের অংশ তিনি ক্রয় করেন। কেন্দুলীর তালুকদার ছিলেন জনুবাজার গ্রামের দত্ত বাড়ি। পরবর্তী সময়ে তিনি কেন্দুলী র তালুক সহ নীলামে পত্তনি তালুক জনুবাজার ও খরিদ করে নেন। একজন নিষ্ঠাবান এবং দরদী মোহান্ত ছিলেন এই ভরতচন্দ্র। তাঁর সময়কাল কেন্দুলীর মোহান্ত অস্থল এর
এক গৌরব ময় সময়।
ফুলচাঁদ ব্রজবাসী নিজে আশ্রম মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন।
মন্দিরের পূজারী ছিলেন যোগেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
আশ্রমে সারা বৎসর পালিত হত নানা ব্রত, উৎসব।
এই সকল ব্রত উৎসবে পুরোহিতের কাজ করতেন লক্ষ্মীনারায়ণ গোস্বামী। শ্রী রামপুর পটির বিখ্যাত পণ্ডিত ঈশ্বর সিদ্ধান্ত আচার্য্য র সাথে ছিল তার গভীর সখ্য।
প্রায় প্রতিদিন ই তাঁদের দেখা সাক্ষাৎ, আলাপ আলোচনা হত।
এই ব্রজবাসী ফুলচাঁদের সময়েই নির্মিত হয় জয়দেব কেন্দুলী র বিখ্যাত পিতলের রথ।
নবরত্ন রাধাবিনোদ  মন্দিরের অনুকরণে নির্মিত হয় বৃহদাকার
পিতলের রথ টি। ১২৯৬  থেকে ১২৯৮ পর্যন্ত এর নির্মানকাজ চলে। এই রথের প্রধান নির্মাতা ছিলেন কেন্দুলীর পশ্চিমে
টিকরবেতা গ্রামের শ্রী বনমালী মণ্ডল।
অন্যান্য যাঁরা এই নির্মান কার্যে যুক্ত ছিলেন তাঁরা হলেন
টিকরবেতা গ্রামের - ক্ষুদিরাম কর্মকার,  ঈশ্বরচন্দ্র কর্মকার, প্রতাপচন্দ্র কর্মকার, বঙ্কুবিহারী কর্মকার, কাঙাল দাস বৈরাগ্য
এবং নবীন হাঁড়ি ।
দুবরাজপুরের -  গণেশ কবিরাজ, রামেশ্বর দাসবৈরাগ্য, ঈশ্বর দাস বৈরাগ্য, পশুপতি দাস বৈরাগ্য।
ভিরিঙ্গি গ্রামের - গণেশ কর্মকার
প্রতাপপুরের - ননীতালাল কর্মকার
কাঁটাবেড়ে গ্রামের - নিকুঞ্জ কর্মকার
" হিসাবের খাতায় দেখা যায় ১২৯৬-৯৭ বঙ্গাব্দে রথ নির্মানের শিল্পী দের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছে প্রায় ১৫০০ / টাকা।
সহজেই অনুমান করা যায় কি বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়িত হয়েছিল সেই বৃহদাকার রথ নির্মানে।
রথ নির্মানের পর এই ফুলচাঁদ ব্রজবাসীর সময় থেকেই কেন্দুলী বিখ্যাত রথযাত্রা উৎসব এর শুরু হয়।
তাছাড়াও রাসউৎসব, দোলউৎসব, এর ও আয়োজন হত।
রামায়ন গান, ভাগবত পাঠ, কৃষ্ণযাত্রা ও অনুষ্ঠিত হত আশ্রমে।
এখানে উল্লেখ্য বিখ্যাত সাধক কবি নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায় তাঁর কৃষ্ণযাত্রার দল নিয়ে পালা গান পরিবেশন করতেন।
সেই আসরে রামপুরের ঈশ্বর সিদ্ধান্ত আচার্য্য মহাশয়ের উপস্থিতি ছিল একান্ত কাম্য। তাঁর সাথে সাধক নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায়ের বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। তিনি আসরে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত কণ্ঠ মশাই গানই শুরু করতেন না।
পিতলের রথের কারুকার্য ---  অসামান্য এর গঠন। নির্মান শৈলী। রূপদক্ষ শিল্পী দের হাতে ফুটে উঠেছে অসামান্য সব
সারল্য ভরা চিত্র। হয়তো ড্রইং - এ সেই দক্ষতা নেই। কিন্তু
শিল্পীরা খোদাই করেছেন মনের আনন্দে। কিন্তু নারীমুখে এসেছে বিষাদ। আছে নগ্নিকারা। প্রশ্ন জাগে এত নগ্নতা কেন!
  সেখানে কি গীতগোবিন্দের বিকৃত প্রভাব! না কি সমাজ চিত্রণ!
ফুলচাঁদ ব্রজবাসী র সময় থেকেই কেন্দুলী তে রথযাত্রা উৎসব
শুরু হয়।  উৎসাহ উদ্দীপনায় রথ কেন্দুলী র পথ পরিক্রমা করে।
দীর্ঘ দিন এই উৎসব চালু থাকার পর নানাবিধ কারনে রথযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। রথ টি ভেঙে ছোট করার প্রয়োজনে রথ টি কে ভাঙা শুরু হতেই জনমানসে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ভীষণ গোলযোগ সৃষ্টি হয়।
যাক শেষ পর্যন্ত রথটিকে আবার মোটামুটি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। তবে অলংকৃত অনেক প্লেট হারিয়ে বা চুরি হয়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত গতবৎসর ; প্রায় পঞ্চাশ বছর পর আবার সেই রথ
বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে জয়দেব কেন্দুলী র পথে নামে। এই রথযাত্রা উপলক্ষ্যে বিশাল জনসমাবেশ ঘটেছিল।
মোহান্ত অস্থল ; তাঁদের সহযোগীগন ; জয়দেব কেন্দুলী সেবা ও সংস্কৃতি সমিতি ; সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ' ভক্তি ভবন ' এর
সদস্য গনের সক্রিয় সহযোগিতায় ঐতিহ্য মণ্ডিত  রথযাত্রা উৎসব জয়দেব কেন্দুলী তে পুনরায় চালু হয়।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------
এই প্রবন্ধে পূর্বাপর সকল ব্রজবাসী মোহান্ত র নাম বা তাঁদের কার্যকাল সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়নি।
সংক্ষেপে -  রাধারমণ ব্রজবাসী কেই প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে গন্য করা হয়। বর্ধমানের রাজা ত্রিলোকচন্দ্রের আমলেই কেন্দুলী র নিম্বার্ক আশ্রমের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল দ্বাদশ বঙ্গাব্দের
ষষ্ঠ অথবা সপ্তম শতকে।

যদিও বর্ধমান রাজবাড়ির দেওয়ানের দপ্তর থেকে এক  পত্র মারফত বৃন্দাবন থেকে আগত  রাধামোহন ব্রজবাসী নামক
এক সাধু প্রকৃতি র ব্যক্তি কে বেশ কিছু জমি জায়গা, এবং নগদ ৩৬১ / টাকা প্রদান করা হয়। ১১৬২ বঙ্গাব্দে ২১ শে মাঘ।  তিনি কেন্দুবিল্বে বসবাস করে সেনপাহাড়ী এবং সেনভূম, শেরগড়, সিলামপুর প্রভৃতি স্থানে
সদাসেবাব্রত পালনের ব্যবস্থা করতেন।
মনে হতে পারে তিনিই হয়তো কেন্দুলীর মোহান্ত অস্থল এর প্রতিষ্ঠাতা। বিশিষ্ট ওড়িয়া গবেষক বনমালী রথ তাঁকেই
গদির প্রতিষ্ঠাতা বলে উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু তাঁর নামের আগে ' সেবাইত '  গোস্বামী, বা মোহান্ত
কোন কথারই উল্লেখ নাই।
ব্রজবাসী রাধামোহন  কেন্দুলীর নিম্বার্ক আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা না হলেও এখানে আশ্রম স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে
তিনি তার ক্ষেত্র রচনা করেছিলেন নিঃসন্দেহে। "
রাজা ত্রিলোক চন্দ্রের সময়ে দ্বিতীয় একটি পত্রে দেখা যাচ্ছে
রাধারমণ ব্রজবাসী কে সেবাইত বলা হচ্ছে। তিনি যে আখড়া ধারী তাও বলা হচ্ছে। সেই জন্য রাধারমণ কেই প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়।
সমাধি ক্ষেত্রে  রাধারমণ ব্রজবাসী থেকে সর্বেশ্বর ব্রজবাসী পর্যন্ত সাতজন গোস্বামী র সমাধি রয়েছে। অন্য কারোর নয়।
হয়তো তাঁরা এখানে দেহত্যাগ করেন নি। বা বৈষ্ণবীয় ধারায়
প্রতিষ্ঠাতা হলে বা আখড়া ধারী সেবাইত হলে তাঁরই সমাধি
সমাধিস্থলে থাকে। এমনকি রাধারমন ব্রজবাসীর গুরু
ভরদ্বাজ মহান্তের ও সমাধি এখানে নাই। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------
ব্রজবাসী  আশ্রম ধারী পূর্বসুরীসাত গোস্বামী র নাম যাঁদের
সমাধি রয়েছে, সমাধি ক্ষেত্রে ------------
১) রাধারমণ ব্রজবাসী  ২) ভরতচন্দ্র  ৩) প্যারীচরণ ৪) হীরালাল ৫) ফুলচাঁদ ৬)রামগোপাল ৭) সর্বেশ্বর
( সকলেই ব্রজবাসী) 

সর্বেশ্বর এর পর মোহান্ত হয়েছিলেন  দামোদর চন্দ্র ব্রজবাসী।
তারপর রাসবিহারী ব্রজবাসী। হরিকান্ত শরণদেব কে স্বেচ্ছায়
মোহান্ত পদ ছেড়ে দেন রাসবিহারী ব্রজবাসী।
" পত্তনি তালুক দার মোহান্ত ' বলে কেন্দুলী র মোহান্ত গণ
নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন বিভিন্ন কাগজপত্রে। অর্থাৎ তাঁরা
একাধারে ছিলেন ধর্মজগতের মানুষ, আবার অন্যদিকে ছিলেন বিষয় জগতের মানুষ। বিষয় বাসনা কে পরিহার করেই
প্রবেশ করতে হয় ধর্মজগতে। তাই ধর্ম ও বিষয় পরস্পর বিরুদ্ধ এই দু ' য়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা সুকঠিন। কেন্দুলী র কোন কোন মহান্তের পক্ষে সেই সামঞ্জস্য বিধান করা সম্ভব হয়নি। আশ্রম পরিচালনার জন্য আয়ের উৎস স্বরূপ কিছু কিছু দেবোত্তর জমি জায়গা হয়তো থাকা দরকার-কিন্তু অগাধ ধনসম্পদের কোন প্রয়োজন হতে পারেনা।জানা যায় দেবতার নামে বিষয় সম্পত্তি উত্তোরত্তর
বাড়িয়ে চলা যেন নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল দু - এক জন মহান্তের
তাই স্বাভাবিক বিষয় বিষে বিষিয়ে গিয়েছিল তাঁদের পবিত্র
সাধক জীবন - তাঁদের আমলে অবাঞ্ছনীয় হীণ কার্যকলাপে
কলুষিত হয়েছিল পবিত্র আশ্রম। "
বর্তমানে আশ্রমের আয় খুবই সীমিত। জমি জায়গা সব বেদখল হয়ে গেছে। উৎপন্ন শস্যের ভাগ চাষি দের কাছ থেকে আশ্রমে আসেনা।
তারই মধ্যে আশ্রম পরিচালনা করতে হয়। কেন্দুলীর নিম্বার্ক আশ্রম কে রাজরাজেশ্বর মঠও বলা হয়। কারণ শ্রী শ্রী রাজরাজেশ্বর ই এই আশ্রমের মূল দেবতা। তিনি শালগ্রাম শিলায় পূজিত হন। রাধারমণ ব্রজবাসী ই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন
এই শালগ্রাম শিলা। পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন নানা
দেবদেবী। চৈতন্য মহাপ্রভু ও গৃহীত হয়েছেন সমাদরে।
  কেন্দুলীর  মোহান্ত আশ্রম নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের হলেও এখানে পূজিত নানা দেবদেবীর অধিষ্ঠান দেখে বোঝা যায় --- রামাইত, মধ্বাচার্য, বল্লভী, গৌড়ীয় ইত্যাদি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বৈষ্ণব ধর্মের মিলনক্ষেত্র কেন্দুলীর এই মোহান্ত আশ্রম।
পৌষসংক্রান্তির অজয়ে স্নানের জমায়েত কে নদী গর্ভ থেকে তুলে এনে ডাঙা য় বা মোহান্ত আশ্রমের সামনের রাস্তার দুপাশে
মেলা বসিয়েছিলেন এঁরাই। মেলার সময় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বৈষ্ণব রা দেশের নানা স্থান থেকে এসে এখানে আশ্রয় নিতেন।
   বর্তমানে সেই সমাবেশ না হলেও আশ্রম পরিচালনা করার
আন্তরিক প্রয়াস রয়েছে বর্তমান ব্রজবাসী সহ সহযোগী  আশ্রম পরিচালক দের।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ সমাপ্ত।
গ্রন্থ ঋণ।  জয়দেব কেন্দুলী র মোহান্ত আশ্রম। ড‌′• অজিত কুমার দাস।
জেলা গেজেটিয়ার। বীরভূম। ও ' ম্যালি
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা লাইন।
গীতগোবিন্দম । সাহিত্য রত্ন হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়
নেট মাধ্যম। উইকিপিডিয়া।
চিত্র ঋণ। পুরাতন রথের ছবি ( সাদা কালো ছবি)
মুকুল দে আর্কাইভ থেকে। সত্যশ্রী উকিল এর সৌজন্যে প্রাপ্ত।
শিবের বিবাহ সহ কয়েকটি প্লেটের ছবি।
------------- ------------ ------------ ------------ ------------ 
** লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সরকারি উদ্যোগের 
" বাউল তীর্থ পত্রিকা য় "। আজ ছিল  মেলার উদ্বোধনী  দিন।আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম।  সেখানেই পত্রিকা প্রকাশিত হল। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ 
মোহান্ত অস্থল এর প্রাচীণ রথের ছবি। 
মূল ছবি। মুকুল দে আর্কাইভ থেকে। সত্যশ্রী উকিল দা র সৌজন্যে প্রাপ্ত। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------

Wednesday, 8 January 2025

সাতকাহনিয়া গ্রামের অধিকারী আমবাগান

সাতকাহনিয়া গ্রামের অধিকারী আমবাগান।। 

ঠুকঠুক করে লাঠি ঠুঁকতে ঠুঁকতে, মালপাড়ার  বিরাট বাসক ঝোপের ভিতর দিয়ে, একটু আড়ালে আড়ালে, পায়ে চলা পথে বৃদ্ধ সলু মিঞা 
আমবাগানে ঢুকতেন। ভর দুপুর বেলা। এই পাড়ার ছেলেগুলো সব পাকা আম পেড়ে নিচ্ছে। তাঁরা কিছু পাচ্ছেন না। আমবাগান পাহারার জন্য  'রেখো বা রাখা '  হিসাবে একজন কে রাখা হয়েছে। সে ব্যাটা ভরপেট তালতাড়ি খেয়ে আমবাগানে দেয় লম্বা ঘুম। আমগাছ পাহারা দেবে কি! নিরাশ মানুষটি আপনমনে ই ঘাড় নাড়েন। 
মনে মনে বোঝেন যে পারা যাবেনা। 
আর তাঁকে বাগানের পশ্চিম মাথায় দেখা মাত্রই 
পুব পাড়ার ছেলে দের দে দৌড়। যে যেদিকে পারে 
গাছের আড়ালে, ভাঁট ফুলের ঝোপের ভিতরে 
লুকিয়ে যায়। বাগানে যেন কেউ কোথাও নেই। 
এমনকি হনুমান গুলোও পালিয়েছে। 
পাকা আমের গন্ধে বাগান ম ম করছে। মাছির ভনভন। 
তো আমরাও তো ছিলাম সে ই দলে। আমি আর হালদার ঘরের কানু। সে বাগানে হালদার দের অনেক খানি অংশ। আর সৈয়দ বংশীয় মুসলিম দের। গাঁয়ে যাঁদের ' মিঞা সাহেব ' বলা হত। 
কানু বলত চল, কে কি বলবে, আমরাও বাগান পাহারা দিচ্ছি। আমাদেরও  বাগান। 
দুপুরে তো ঘুম নেই। কানু এসে চপলা পিসির ঘরের পিছন থেকে ডাক দিত। এই চপলা পিসি একাই থাকতেন। হালদার ঘরের ই স্বামীপরিত্যক্তা 
মেয়ে। অবশ্য তখন তাঁরও যথেষ্ট বয়স হয়েছে। 
তাঁর খামারের আমগাছটির আম খুব মিষ্টি। পিছনে রাস্তার দিকে যে ডালটা গেছে সে ডালেও অনেক আম ধরত। চপলাপিসি একটি আমও পেতেন না। " খা, খা, কারা খাচ্ছিস আমি সব জানি "। ঘরের থেকেই ডাক ছাড়ত। 
কেউ পাত্তা দিলেই তো। ঐ ডালের আম পাকলেই হল। ক দিনেই শেষ। 
দাদু দিদিমা ঘুমালে বেরিয়ে আসতাম। কানু আর আমিও সেই ডুমুরতলা হয়ে মাল পাড়া দিয়ে বাগানে। 
আবার কোন কোন দিন ডাকবাংলোর কর্মচারী 
পঙ্কজ বাবুর টিনের চালার এক কামরার কোয়ার্টারে। আমরাই ছিলাম পঙ্কজ বাবুর দুপুরের সঙ্গী। একাই থাকতেন। মাঝে মাঝে তাঁর ছেলে 
বাসব আসত। সে ভালো ফুটবল খেলত। 
এই সময়ে এলে বাসব ও আমাদের সাথে যোগ দিত।বাসার পিছনেই ছিল ডাকবাংলোর সীমানা। 
সেখানে ছিল লোহার পিলারে কাঁটা তারের বেড়া। 
কিছু কিছু জায়গায় তার ফাঁক। ফাঁক মানে ফাঁক করে নেওয়া হয়েছে। ডাকবাংলোর ভিতরে আছে 
কমপক্ষে সাত আট টি আমগাছ। নানা ধরনের আম। একটা আম ছিল কাঁচা তেও, একবিন্দু টক ছিলনা। আমরা ডাকবাংলো ছেড়ে অধিকারী বাগানে ঢুকতাম। তারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে। 
বাগানের নাম অধিকারী বাগান। 
একদিন অধিকারী রাই মালিক ছিলেন নিশ্চয়ই। 
অধিকারী বামুন দের এ গাঁয়ে সবই ছিল। জমি জায়গা, বাগান, পুকুর সবই। ছিল তাঁদের বিষ্ণু দালান। শোনা যায় দোল, রাস এসব পরব হত। 
একদিন তাঁরা এই গ্রাম ছেড়ে চলে যায় ছোট রামচন্দ্রপুরে। নাকি গাঁয়ের প্রভাবশালী দের দাপটের ভয়ে। 
জলের দরে  বাগান, পুকুর সব বেচে দিয়ে যান। 
কিনে নেন হালদাররা আর মুসলিমরা। 
কিন্তু এগাঁয়ের সাথে তাদের একটি পরিবারের যোগাযোগ থেকে গিয়েছিল। সীতারাম কাকা আর তাঁর দাদা কি ভাই, হালদার বাড়ির নানা অনুষ্ঠানে, 
উৎসবে, পরবে তাঁদের ডাক পড়ত। 
সীতারাম কাকা রা ভালো রান্না করতে পারত। 
তখন ভোজেকাজে রান্না করাটাই হয়েছে পেশা। 
জয়দেব কেন্দুলী র কাঙ্গাল ক্ষেপাচাঁদ আশ্রমে মহোৎসবে রান্নার জন্যও তাঁদের ডাক পড়ত। 
কেননা আশ্রম পরিচালনা করেন সাতকাহনিয়া গ্রামের কাঙ্গাল ক্ষেপাচাঁদের শিষ্য রজনীকান্ত হালদার মশাই এর উত্তর পুরুষ রা। শিবদাস হালদার মশাই ছিলেন কর্মদক্ষ মানুষ। তিনিই মূলত মহোৎসব পরিচালনা করতেন। অন্য অনেক সহযোগীরাও  ছিলেন কিন্তু তিনিই ছিলেন হাঁকডাকে দক্ষ মানুষ। 
সেই হালদার বাড়ির ছেলে কানু। আমরা সমবয়েসী। অতএব স্বাভাবিক বন্ধুত্ব। আর পাড়ায় অন্য কোন ছেলে নাই। 
একদিন বাগানে ঢুকেছি। আর দেখি সামনেই সলু মিঞা। আর লুকোবার উপায় নাই। তবু আমি একটা মোটা গুঁড়ি র আড়ালে। 
কানু এগিয়ে গেল। কানুকে দেখে ' অ, হালদার দের শিবুর ভাই '। তা এই দুপুর বেলায় বাগানে, কি ব্যাপার! 
দাদু, আমরা পাহারা দিচ্ছি। মাল পাড়ার ছেলে গুলো এসেছিল। আমরা তাড়ালাম। তুমি যাও, তোমার ঘরে আম পাঠিয়ে দেব। 
বলছিস। বেশ। তা গাছের আড়ালে ঐ টা কে রে। 
ঠিকই দেখেছে। অ মাষ্টারের লাতি "
বলতে হবে মাষ্টার কে। দ্যাখো গে তোমার লাতির কাণ্ড। দুপুর বেলায় কি করে! 
ব্যস। আমার বুক ঢিপ ঢিপ। আমার শুকনো মুখ দেখে কানু ই বলল " ও দাদু  আজকেই এসেছে। আমি ডেকে এনেছি। দুদিক পাহারা দিতে হবেনা '
হ্যাঁ তা বটে পুব দিকের বামুন পুকুর এর দিক থেকে অনেকে বাগানে ঢোকে। 
বেশ, ঠিক আছে। আমি কিছু বলাবলি করবনা। 
আমি যেন আম পাই। 
ও দাদু কয়েকটা ভালো আম নিয়ে যাও। মাল পাড়ার ছেলে গুলো ফেলে পালিয়েছে। কানু ঝোপের আড়াল থেকে গোটা পাঁচেক আম এনে 
বৃদ্ধের হাতে দিতেই তাঁর চোখ আনন্দে চকচক করে উঠল। ঘাড় নাড়তে নাড়তে তিনি ফেরার পথ ধরলেন। বেশ আজ আমি চললাম। এবার ফণী কে পাঠাতে হবে। সে  ভালো পারবে। 
এই আম বাগানে যে কত রকমের আম গাছ ছিল! 
কত স্বাদের। কারও বেল গন্ধ, তো কারও জোয়ান গন্ধ, খই নাড়ু, সিন্দুরে ' ল্যাঙড়া, আরও কত রকমের। কোন গাছের আম কেমন আমরা ঠিক জানতাম। সবচেয়ে মিষ্টি আমের গাছ গুলোই ছিল আমাদের লক্ষ্য। গাছে তো চাপা সম্ভব নয়। ঐ কুড়নো ই ভরসা। আর পুব পাড়ার ছেলেরা গাছে উঠে যায়। তো কোন কোন দিন ডাকবাংলোর চৌকিদার রতন মালের ছেলে গুডু আমাদের আম পেড়ে দিত। পঙ্কজ বাবুও হ্যাঁ করে দিতেন ওকে। 
কমপক্ষে দশ বারো টা আম না নিয়ে আমরা ঘর যেতামনা। গুডু কে দিতাম। পঙ্কজ  বাবুকে দিতাম। 
 আম তো আমরা কোনদিন কিনে খাইনি। ভাবনাতেই ছিলনা। গাঁয়ের মানুষ কবে আবার আম, আতা, আঞ্জির,পেঁপে, তাল, বেল  এ সব কিনে খেয়েছে! 
কিনে খাবে কি!  পয়সা কোথায়! কোন রকমে দুটি ভাত জোটে। তো তরকারি জোটেনা। কাঁচা লঙ্কা, নুন, আর পেঁয়াজ দিয়েই খায়। 
ভাদ্র মাসে তালের মাড়ি চুষেই অনেকে পেট ভরায়। গোটা গাঁ  তাল গাছে গাছে ভরা। 
তারপর, তারপর এক সেই দিন। 
আমবাগানে তাঁবু পাতল গাছ কাটা দের দল। 
এলো বড় বড় করাত আর দড়ি, দড়া। আর রান্না রান্নার হাঁড়ি কুড়ি। বালতি। 
আমরা অবাক বিস্ময়ে শুনলাম এই গোটা বাগান 
কাটা হবে। বাবুরা সবাই বাগান বেচে দিয়েছে। 
হ্যাঁ রে সব গাছ কেটে দেবে! 
কানু নিরুত্তর থাকে। 
পঙ্কজ বাবু র কোয়ার্টার এর ঠিক পিছনেই যে আম গাছ টা ছিল সেটা ছিল আমাদের খুব প্রিয়। 
ল্যাঙরা আমের গাছ। মোটা নীচু গুঁড়ির দুপাশে দুই ডাল। গোল ছাতার মতো গাছটা। 
এই গাছটাকে রাখা যায়না। আমার আকুল প্রশ্ন। 
চলনা, বাবুদের গিয়ে বলি একটা গাছ ছাড় দাও। 
একটা গাছ থাক। 
কানুকে বলি চল তোদের বাড়ি যাই।বড় হালদার দের বাড়ি যাই। মুসলিম পাড়া যাই। 
চল, কানু। বলে আমি হাঁটা দিই। কানু ও সঙ্গে আসে। কানু বলে, গাছকাটা দের দলের একজনকে দেখে  " হ্যাঁ, এই লোক টাকে আমাদের ঘরে একদিন আসতে দেখেছি। "
কি সব আলোচনা হচ্ছিল ঘরে, যে সব পুকুর বাগান সরকার থেকে নিয়ে নেবে। বেশি থাকলেই। 
তাই গাঁয়ে  গাঁয়ে মালিকরা সব বাগান বিচে দিচ্ছে। 
তাহলে কি হবে! 
কি আর হবে! 
চল। ঘর চল। 
কানু চুপচাপ ঘরে ঢুকে গেল। 
আমাকে আর ডাকলো না। 
আমি তাদের বাইরের দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ওখান থেকে চলে এলাম। 
দুপুরে করাত চলে। রাতেও চলে। শুয়ে সারারাত ধরে করাতের কর্কশ  আওয়াজ শুনি। 
এক একটা গাছ পড়ে আর আমার বুকের ভিতর টা যেন কেঁপে কেঁপে ওঠে। 
------------ ------------ ------------ ------------ 
* যাঁকে সলু মিঞা বলেছি তার প্রকৃত নাম সৈয়দ মহম্মদ মুসা 
ফণী মিঞা ; ভালো নাম সৈয়দ আনোয়ারুল হক। 

গ্রাম। সাতকাহনিয়া 
পোষ্ট। বনকাটি 
জেলা। পশ্চিম বর্ধমান

Monday, 6 January 2025

চলুন। ফেরা যাক এবার। পানাগড় এর দিকে

।। চলুন ফেরা যাক।। 
তাহলে এবার ফিরতে হয়।আর কেন। বেশ হল। ভালোই তো। এসেছিলাম শান্তি নিকেতনের মেলা। আর যদি হয়ে যায় একটু এদিক ওদিক ঘোরা। এই সুরুল, রাইপুর, সুপুর, ইটাণ্ডা, এই সব জায়গায়। বেশ একটা হেরিটেজ ট্যুর এর মতো। 
তো প্রণব বাবুর সাথে গল্প করতে করতে ইটাণ্ডা হল। বেশ ভালো লাগলো। 
শুধু ইটাণ্ডা কেন সবগুলিই হল। নিজেদের গাড়ি ছিল।  ফিরতে তো হবেই। সপ্তাহ অন্ত হল যে। 
 সেই এগারো মাইলে এসে আবার  প্রণব বাবুকে সাথে পেলাম।  এবার ওঁর কথা শুনতে শুনতে চলেছি পানাগড় এর পথে। রাজ্য সড়ক। পানাগড় মোরগ্রাম হাইওয়ে। 
,, আমরা দাঁড়িয়ে আছি সীমান্ত রেখায়। বুঝলেন। 
 এই রাস্তা সীমান্ত। এর পূর্বে, ঐ দেখুন রাস্তা চলে গেছে আদুরিয়া অমরপুর এর হয়ে আরও পূবে। 
থানা - আউসগ্রাম। গুসকরা মোড় থেকে চমৎকার বনপথ চলে গেছে গুসকরা বা ভেদিয়ার দিকে। 
কালিকাপুর মৌখিরা আছে ঠিক এই নীলকুঠীর জঙ্গলের খোয়াই এর নীচে। প্রাসাদ আর মন্দির নগরী। না দেখা থাকলে দেখতেই হবে 
আর ঐ দেখুন রাস্তা চলে গেছে অযোধ্যা বনকাটি হয়ে আরও পশ্চিমে গড়জঙ্গল, ইছাই ঘোষের দেউল পার হয়ে আরও পশ্চিমে। কাজলাডিহি নবগ্রাম , শিবপুর দুর্গাপুর  রাস্তাপর্যন্ত।  পাশে পাশে  অজয়। 
অজয়ের ওপারে মানে উত্তর পাড়ে জয়দেব কেন্দুলী। বেশী দূরে নয় কিন্তু। বীরভূমে। 
কি জানি মেলার সময় এসেছেন কি না। 
এই পথের পাশেই আছে " তেপান্তর নাট্য গ্রাম "
যদি না এসেছেন, একবার এসে নিজের চোখে ই  দেখবেন। বেশী এখানে বলছিনা। 
রাস্তার এপারে মানে পশ্চিমে কাঁকসা থানা। 
অর্থাৎ দুটো থানা এলাকার সীমানা আমাদের এই বড় রাস্তা পানাগড় মোরগ্রাম হাইওয়ে। 
জঙ্গল শুরু হবার আগে বাঁদিকে মাজুড়িয়া গ্রাম। 
আর ডানদিকে রঘুনাথপুর গ্রাম। 
আদুরিয়া। বড়ো আদর করে রাখা নাম। কি বলুন। 
সার্ভেয়ার জেনারেল রেণেল সাহেবের ম্যাপে (১৭৬৯) আদুরিয়ার উল্লেখ আছে। পথ চলে গেছে 
আদুরিয়ার পাশ দিয়ে ভাতকুণ্ডা মানকর হয়ে বর্ধমানের দিকে। 
আর পশ্চিম দিকে সেই রাস্তা সেনপাহাড়ি র ভিতর দিয়ে। এই পশ্চিম প্রান্তের কোন গ্রাম নামের উল্লেখ নাই। একটু অবাক লাগে। গোটা টাই জঙ্গল দেখানো আছে। অজয় পার হয়ে সে রাস্তা চলে গেছে রাজনগর এর দিকে। 
ইছাইঘোষের দেউল আছে। অযোধ্যা বনকাটি র মতো জনপদ আছে। সাতকাহনিয়া আছে। 
গৌরাঙ্গপুর আছে। বা সেদিনও ছিল। মাথা উঁচু করেই ছিল। কেন ম্যাপে কোন স্থান উল্লেখ নাই। আমাকে ভাবিয়েছে খুব। হয়তো তাঁর সহকারী রা 
 উল্লেখযোগ্য নয় ভেবে ভুল করেছেন। 
যাই হোক আমাদের পূব দিকে ঐ যে আদুরিয়া অমরপুর শ্রীচন্দ্রপুর গ্রাম। সম্পন্ন গ্রাম ছিল আদুরিয়া। 
অমরপুর এর পিতল শিল্পের খ্যাতি ছিল খুব। 
দেবী অমরচণ্ডী র নামে অমরপুর। 
পিতলের দ্রব্যের কারিগররা ছিলেন খুবই দক্ষ। 
বিখ্যাত উখরার হাণ্ডা জমিদার বাবুদের পিতলের রথের প্রধান কারিগর ছিলেন রাধাবল্লভ মেহতরী। 
নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হবেনা। এত সুন্দর তার অলংকরণ। 
কবিরাজ রা খুবই ধনী ছিলেন। ঝুড়ি ভর্তি মোহর 
জলে ধুয়ে ছাতে রোদে শুখুতে দিতেন 
গোটা পাড়া জুড়ে ছোট ছোট চালা রীতির শিবমন্দির। আবার পাশাপাশি মুখোমুখি দুটি 
শিখর দেউল শিবমন্দির। আর ছিলেন বিষ্ণু। 
এক পরিবারে নৃসিংহ দেবতার ক্ষোদিত মূর্তি পূজিত হন। মিলিত ভাবে অমরপুর আদুরিয়া
ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ এক গ্রাম। 
মাজুড়িয়ার কথা। জুড়ি নাই যার। টোল শিক্ষার কেন্দ্র ছিল। 
রঘুনাথপুর সম্পন্ন গ্রাম ছিল। 
রঘুনাথপুর থেকে ঐ যে পশ্চিমে পিচ রাস্তা চলে গেছে মলানদিঘী হয়ে দুর্গাপুরের দিকে। মলানদিঘী এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। 
কেন গুরুত্বপূর্ণ! বলতে গেলে আরও একটু সময় লেগে যাবে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এবং পেশগত শিক্ষার নানা প্রতিষ্ঠান এখানে গড়ে উঠেছে।
রঘুনাথপুর এর জঙ্গল বড় নয়। পার হয়ে এলাম। 
বাঁদিকে বেলডাঙা গ্রাম। ব্যতিক্রম। এ গ্রাম আছে 
বড় রাস্তার পূর্বে। এই বেলডাঙা থেকে রাস্তা চলে গেছে ধানতোড় কে পাশে রেখে ছোট রামচন্দ্রপুর, আড়জুড়ি, তিলং, রাঙাখুলা। আপনাদের মনে হবে বড়রাস্তা থেকে এত ভিতরে এই সব গ্রাম আছে! যাইহোক 
এবার পিয়ারীগঞ্জ, আর পশ্চিমে তেলিপাড়া। 
বর্ধমানের এক রাণী প্যারীকুমারী র নামে পিয়ারীগঞ্জ। পুরনো গ্রামে অনেক শিবমন্দির ছিল। 
তেলিপাড়া। তাবলে তেলিদের গ্রাম নয়। তেলিরা আছেন বটে। গাছতলায় আছেন দেবী তিলাইচণ্ডী 
বা তিলুইচণ্ডী। সেখান থেকে তেলিপাড়া। 
এই দেখলেন, কখন হুস করে পেরিয়ে গেছি ছোট্ট কুনুরের সেতু। ছোট্ট কুনুর এখানে একটা নালার মতো। কিন্তু আরও নীচে বেশ চওড়া। অতিবৃষ্টি হলে ভাসায়। এমনকি গুসকরা শহরের  নীচু এলাকা জলমগ্ন হয়। এই গুসকরা শহরের উপর দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা চলে গেছে। গরম সামান্য বেশী অনুভূত হয়। 
দোমড়া। দুই মোড়ের জায়গা। আবার কেউ বলেন ডোম রা। এখানের বৈষ্ণব আশ্রম টি প্রাচীণ। 
গ্রামের ভিতরে আছে একটি শিবমন্দির। বাইরে একটি চাঁদনী রীতির বিষ্ণু দালান। এখানেরামকৃষ্ণ আশ্রমের শাখা কেন্দ্র আছে। 
বর্ধমানের রাজা ত্রিলোক চন্দ্রের নামে গ্রামের নাম ত্রিলোকচন্দ্রপুর। অনেক বিশিষ্ট, সম্পন্ন পরিবার এখানে আছেন। পাল পরিবারের খ্যাতি ছিল নানা ব্যাধি উপশমের জন্য আয়ুর্বেদিক তেল তৈরী তে। 
পূর্ব দিকে রাস্তা চলে গেছে দেবশালা হয়ে মানকরের দিকে। দেবশালার প্রাচীন নাম রাজগড়। তার মানে বুঝতেই পারছেন যে একটা গড় ছিল। তাবলে এ গড় রাজস্থানের দুর্গ নয়। 
মোটা ইঁটের প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। 
রাজগড়ের অনেক গল্প কথা। পরে হবে। আচ্ছা আপনারা কাগজে হয়তো লবনধার গ্রামের নাম শুনেছেন। ভুল ভাবে বলা হচ্ছে আল্পনা গ্রাম। 
আলপনা নয় বরং বলা উচিৎ " চিত্রিত গ্রাম। "
আপনারা যাঁরা শহরে থাকেন তাঁরা ভাবতেই পারবেন না ঐ মাঠ, জঙ্গলের ওপারে এমন সব সম্পন্ন, সমৃদ্ধ গ্রাম আছে। 
যাই হোক শুরু হল ধোবারুর জঙ্গল। এই জঙ্গল কে বলা হয় " সাতকাটার জঙ্গল "। সেই সময়ে মানে মাত্র দুশো বছর আগে জঙ্গল ছিল জঙ্গলই। 
আবার জঙ্গলের মধ্যে পূর্ব দিকে গ্রাম আছে - ধোবারু। পশ্চিম দিকে গ্রাম আছে গাণ্ডাদহ, রাজকুসুম। কি সুন্দর নাম বলুন। রাজকুসুম। 
এখানের গঁড়াই পরিবারের সরস্বতী পূজা খুব বিখ্যাত। আবার এই জঙ্গলের মধ্যে যাদের থাকা স্বাভাবিক  সেই তারাও ছিল, মানে 
 চোর, ডাকাত, রাও ছিল। এই জঙ্গল ই তো ছিল তাদের ডেরা। কার বা কাদের হাতে সাতজন কাটা পড়েছিলেন। তার কোন নথি নাই। 
অনুমান বৈদেশিক আক্রমণের মুখে পড়ে কাঁকসা রাজবংশ ধ্বংস হয়। সৈয়দ বুখারী ছিলেন তাঁদের নেতা। প্রবল যুদ্ধের শেষে কাঁকসা পরাজিত হয়। 
সেই সময়ের ঘটনা হবার সম্ভাবনা বেশী। রাজবংশের সাত সৈনিক বা পাহারাদার, বা সেনাপতি বা রাজবংশের সাত ব্যক্তি যাঁরা হয়তো যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন, তাঁরা অতি দ্রুতগামী অশ্বের সামনে দাঁড়াতে পারেননি। নিহত হয়েছিলেন। 
এই আমাদের এখনকার কাঁকসা থানা এলাকা সেদিনের পরগণা সেনপাহাড়ী। সেন রাজাদের পূর্ব পুরুষ রা এসে গড়জঙ্গলের গভীরে সম্ভবত রাজা 
কর্ণসেনের আশ্রয় নিয়েছিলেন। কর্ণসেন ছিলেন পাল রাজাদের সামন্ত। মেদিনীপুর এর ময়নায় ছিল তাঁর আসল রাজত্ব। তিনিও দক্ষিনী। সেন রাজাদের বাঙ্গলায় আদি বাসস্থান হিসাবে এই এলাকার নাম হয়ে যায় 
" সেনপাহাড়ী "
চলুন, প্রায় এসে গেছি। জঙ্গলের ভিতরে ভিতরে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের রাস্তা,রানওয়ে,  নানা নির্মান। একটু দূরেই বিমানঘাঁটি। 
রেল লাইন স্থাপনা কে কেন্দ্র করে পানাগড় বাজারের গড়ে ওঠা। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে 
আদি জি টি রোড। 
কাঁকসা প্রাচীণ জনপদ। রাজা কঙ্কসেন - কনকসেন থেকেই কাঁকসা নাম এসেছে। এই এক মত। আর এক মত কাঁকসা তাঁদের পদবী। 
যেমন ভবানীপতি কাঁকসা। তাঁর নাম থেকে কাঁকসা। 
এসে গেছি পানাগড় রেলস্টেশনে। 
এবার ট্রেন আসার দেরি আছে। বসে বসে মনে মনে এঁকে ফেলুন ছবি। সাল ১৮৫৫। রেল চালু হল হাওড়া থেকে রাণীগঞ্জ। পানাগড় স্টেশন হল। 
আজকের স্টেশন রোড হল মাটি মোরামের রাস্তা। 
চলে গেছে কাঁকসা ডাকবাংলোর পাশ দিয়ে উত্তরে এগারোমাইল, ইলামবাজারের দিকে। 
দাঁড়িয়ে আছে গোরুর গাড়ি। খড় চিবুচ্ছে বলদ দুটো। গাড়োয়ান জল খেতে গেছে পাকুড়তলার ময়রাদের দোকানে। ভালো বাতাসা, কদমা, মণ্ডা পাওয়া যায়। 
বেশ আসুন। আবার আসবেন। এবার যখন আসবেন এই গোটা এলাকা টা চক্কর দেবেন। 
আর যদি আমাকে সঙ্গে পেয়ে যান। "
–------------ ------------ ------------ ------------ 
------------ ------------ ------------ ------------ 
©  প্রণব ভট্টাচার্য। 
হ্যাঁ, একটা কথা বলে নিই। প্রণব বাবুর লেখা একটা ছোট্ট বই আছে। ইলামবাজার কে কেন্দ্র করে কুঠিবাড়ি ভিত্তিক সেদিনের নীল গালা সুতী বা রেশমের  ব্যবসা 
নাম।  এলেমবাজার নিলামবাজার ইলামবাজার। দাম মাত্র দুশো টাকা। 
অক্ষর যাত্রা প্রকাশনীর আনন্দগোপাল হালদার কে ফোনে অর্ডার দিলেই বাড়িতে বসে বই টি সংগ্রহ করতে পারেন। 
ফোন নং 9474907307 
কেন বললাম, না এখানে ইলামবাজার, দ্বারোন্দা, সুরুল, রাইপুর, সুপুর সবার কথা এই বইয়ে আছে। 
পড়ে দেখবেন। আশা করি ভালো লাগবে। অনেক তথ্য আছে। এপার ওপার অজয়ের দুপারের কথা ই আছে। 
-----* আপনারা কিনে পড়লে দ্বিতীয় সংস্করণ টি 
 করতে পারি।   নমস্কার । 
গল্প শুনছেন। "  সেনপাহাড়ীর কথক ঠাকুর " কে কিছু দক্ষিণা দেবেননা!! 
বছর শেষ। আজ ৩১ শে ডিসেম্বর। ২০২৫ এর শুভেচ্ছা কামনা করি। সবাই ভালো থাকুন।। 
------------ ------------ ------------ ------------

Friday, 3 January 2025

ভ্রমি বীরভূমে

আমি থাকি অজয়ের দক্ষিণে। পশ্চিম বর্দ্ধমান জেলা য়। অজয়ই প্রাকৃতিক  সীমারেখা। উত্তরে বীরভূম। দক্ষিণে বর্ধমান। সেই কবেকার এই সীমারেখা। অজয়ের উত্তরে উত্তর রাঢ়। বজ্রভূমি, বীরভূমি - বীরভূম। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী ১৮০৬ সালে অজয় কে  প্রাকৃতিক সীমারেখা হিসাবে গ্রহণ করে। 

ওপারে ইলামবাজার। বীরভূমের প্রবেশ দ্বার। 

আমাদের নিকটতম গঞ্জ। এপার ওপারের  নিত্য যাতায়াত। সীমান্তের এই অংশের মানুষ দের বরাবরের টান ওপারের প্রতি। পানাগড়, দুর্গাপুর

যাওয়া অপেক্ষা বোলপুর যাওয়ার প্রতি একটা প্রবণতা কাজ করে। এই এলাকার অনেক সম্পন্ন

মানুষ ওপারে চলে গেছেন। ইলামবাজার বা বোলপুরে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন। 

আমারও ইচ্ছা ছিল।কিন্তু নানা কারণে হয়নি।  ইলামবাজার হাইস্কুলে পড়েছি। 

কিছুদিন পড়িয়েছি। বোলপুর কলেজে পড়েছি। 

সামাজিক, সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ডে বীরভূমে

অনেক গুলি বছর কাটিয়েছি। বীরভূমের প্রতি 

আলাদা এক ভালোবাসা কাজ করে। সেই ভালোবাসা থেকে ই আমার সামান্য বীরভূম চর্চা। 

আমার লেখালেখির বড় অংশ জুড়েই বীরভূম। 

তাই প্রথম বই টি করতে পেরেছি ইলামবাজার কে কেন্দ্র করেই।  কুঠিবাড়ি ভিত্তিক ব্যবসা বাণিজ্য। 

এবং ইলামবাজারের কথা ও কাহিনী। 

অন্যান্য যে সব লেখা এই সমাজমাধ্যমে, ফেসবুক পেজে বা ব্লগে রয়েছে বা নানা পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে সেই সব লেখা একত্রিত করার ইচ্ছা  আছে। ইচ্ছা ই - বুক করার ও। আমি চাই আমার সব লেখা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে। 

কিনে বই খুব কম জনেই পড়ে। আমার ধারণা আগামী তে মানুষ এখানেই পড়ে নিতে চাইবে। 

 কিন্তু বইমেলায় বেশ ভিড় হয়। বই এর একটা আলাদা মূল্য আছে অস্বীকার করিনা। বই, বই ই। 

তবু অনেক কথা আছে। আমার যা অভিজ্ঞতা সে না হয় আরেক দিন বলা যাবে। 

আজ বীরভূম বিষয়ক লেখালেখির একটা  তালিকা। 

  • বীরভূমের লোহা মহল 

  • মুলুটির মন্দির রাজি, 

  • গণপুরের মন্দির, ' ফুলপাথরের মহাকাব্য'

  • মল্লারপুর 

  • রাজনগর কথা 

  • রসা - বড়রা র প্রস্তর দেউল 

  • বীরভূমের বৈচিত্র্যময় মন্দির 

  • দুবরাজপুর কথা ও কাহিনী 

  • দুবরাজপুরের মন্দির 

  • হেতমপুর কাহিনী। চন্দ্রনাথ মন্দির। রাজবাড়ি 

  • কোটা - শীর্ষা 

  • টিকরবেতার পিতল শিল্পের কথা 

  • জয়দেব কেন্দুলী নিয়ে নানা লেখা 

  • রাধাবিনোদ মন্দির। মোহান্ত অস্থল এর পিতলের রথ, গীতগোবিন্দম এর জয়দেব 

  • মানুষ জয়দেবের খোঁজে 

  • ধর্মমঙ্গলের অন্যতম কবি নরসিংহ বসুএবং তাঁর  রাজনগর যোগ। 

  • ১৬৩৩ সালে নির্মিত ঘুড়িষার রঘুনাথজীর মন্দির এবং ১৬৩১ সালে মাসড়া গ্রামে তৈরি মন্দির। একটি তুলনামূলক আলোচনা। 

  • ঘুড়িষা গ্রামের দুই বিখ্যাত মন্দির 

  • ইলামবাজার। গঞ্জ ইলামবাজার কথা। 

  • ইলামবাজারের মন্দির 

  • ইলামবাজার কেন্দ্রিক নানা বিধ লেখা। 

  • 'তুলাপট্টিতে আর বসেনা নীলামের হাট '

আনন্দবাজার পত্রিকায় বড় প্রবন্ধ। 

  • সুরুল, রাইপুর, আদমপুর, চন্দনপুর, মির্জাপুর, সুপুর, ইটাণ্ডা নিয়ে নানা লেখা এবং ছবি। 

  • এছাড়াও যেখানের সম্বন্ধে হয়তো লেখা হয়নি সেখানের মন্দির টেরাকোটার ছবি। 

  • আপনারা জানেন মন্দির টেরাকোটা আমার অন্যতম প্রিয় বিষয়। বনকাটির মন্দির এবং ইলামবাজারের মন্দির দেখেই সেই বালক বয়সেই এই ভালোবাসার উন্মেষ। 

  • যেমন ইলামবাজারের আরস্কাইন সাহেবের কুঠিবাড়ির ভগ্নাবশেষ বা তাঁদের পরিবারের সমাধি ক্ষেত্র থেকেই,নীল ও গালা শিল্পের একদা বিখ্যাত কেন্দ্র সেই প্রাচীণ ইলামবাজার কে খোঁজা। ইলামবাজারের চারপাশ কে খোঁজা। যেমন ঊষহর, ধল্লা, দ্বারোন্দা, দেউলী, ইত্যাদি স্থান সম্পর্কে লেখা। 

  • এখনকার এই মাধ্যমের সুবিধা হচ্ছে 

দৃশ্য শ্রাব্য মাধ্যম। এখানে আছি দীর্ঘদিন। কয়েক হাজার ছবি নষ্ট হয়ে গেলেও, এখনও আছে কয়েক হাজার। 

  • বিরাট বিস্তৃত ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে আমার সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখেই আমি নির্দিষ্ট একটা ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চেয়েছি। 

  • প্রাচীণ গোপভূমের অন্তর্ভুক্ত পরগণা সেনপাহাড়ী এবং বীরভূমের সেনভূম তথা 

অজয় তীরের দুপারের মানুষের জীবন কথা। 

আমার সীমিত সামর্থে এই কাজটুকুই মাত্র করতে পেরেছি। 

আমার কোন উচ্চাভিলাষ নাই। আমি সামান্য এক আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চাকারী। ক্ষেত্রসমীক্ষক। কোন স্থান নিজের চোখে না দেখে, আমি কোন লেখা লিখিনা। 

আমি কোন 'মুখ' নই। যেমন " বীরভূমের মুখ "। কি "পুরুলিয়ার মুখ " বা "বাঁকুড়ার মুখ "। সে সামর্থ্য নেই। অনেক জ্ঞানী, পণ্ডিত, বিদগ্ধ লেখক  জনেরা আছেন। 

আমি আঞ্চলিক ইতিহাসের  গল্পকার, কথাকার। সমাজমাধ্যমের বন্ধুরা বলেছেন " সেনপাহাড়ীর কথাকার"

কেউ " সেনপাহাড়ীর কথক ঠাকুর " 

কেউ " জঙ্গলমহলের কথাকার "

এই রকম নানা অভিধা। যথেষ্ট। 

বাইরের বন্ধুরা জানেন আমি বীরভূমের। 

বীরভূম কি জানে কি জানি! 


যে সব সংকলন গ্রন্থে আমার বীরভূম বিষয়ক প্রবন্ধ গুলি প্রকাশিত হয়েছে 

তার একটা তালিকা যদি পারি, দেব। 

আপনাদের জ্ঞাতার্থে।  কিছু কাজ তো করেছি। ভবিষ্যৎ ই বলবে। 

অনেক ধন্যবাদ। নমস্কার। 

------------ ------------ ------------ ------------ ©  প্রণব ভট্টাচার্য। 

** ইলামবাজার কেন্দ্রিক আমার ছোট্ট বই টি র 

 নাম " এলেমবাজার নিলামবাজার ইলামবাজার "

দাম মাত্র ২০০/ টাকা। বন্ধুরা ঘরে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন। পরিবেশক অক্ষরযাত্রা প্রকাশনী র আনন্দ গোপাল হালদার। ফোন নং 9474907307. ফোনে অর্ডার দিলেই হল। 

------------ ------------ ------------ ------------ 

আমাকে ফেসবুকে ই পাবেন। অনুরোধ না জানালে কোথাও লিখিনা। ফেসবুক পেজে শুধু রিলের ভীড়। ওখানে লেখা কেউ পড়েননা। 

বাংলা ব্লগের তেমন চাহিদা নাই। তবুও একটা ব্লগ আছে। 

https:// matirpradip.blogspot.com 

ফেসবুক পেজ। Pranab's canvas 

ইউ টিউব চ্যানেল খুলেছিলাম। চালাতে পারিনি। 

এই। 

------------ ------------ ------------ ------------ ----






Thursday, 2 January 2025

কথা - সাতকাহন। তাঁ তি বাগান

সাতকাহনিয়া গ্রামের তাঁতিবাগান

এ গাঁয়ের বয়স কত! জিজ্ঞেস করলে প্রবীণরা বলতেন ' গাছ পাথর নাই ' বাবা । তার মানে সে অনেক পুরনো। কারা না ছিল! আজ আর তারা যে ছিল তার নিদর্শন বলতে তাদের বাস্তুবাড়ী গুলো এত দিনের জল,ঝড়, ঝঞ্জা,র আঘাতে  ছোট ছোট ঢিপি। এমন ছোট বড় ঢিপি তে ভর্তি  সেই পুরনো গাঁয়ের ' নামো পাড়া '। একটু নীচু। উত্তরে। নদীর অনেক কাছাকাছি। নদী মানে অজয় নদ। তখন নদী টার আজকের দশা হয়নি। বছরের কয়েক মাস নৌকো চলত। নীলবাড়ির মাঠ আছে। কলাবাগানের ঘাট আছে। নীল বাড়িতে নীলের চাষ হত। ঐ পুরনো গাঁয়ে নীলের চৌবাচ্চা ছিল। 
মানে নীল তৈরী হত। তাহলে নীলের ব্যবসা হত। 
কলাবাগানের ঘাট থেকে ইলামবাজার শিমূল তলার সাহেব ঘাট। সাহেব মানে আরস্কাইন সাহেব।ইলামবাজারের তাঁর বিশাল কুঠিবাড়ি। বিশাল ব্যবসা। নীল আর গালার। চারপাশ থেকে মাল আসত তার কুঠিবাড়ি সংলগ্ন গুদাম ঘরে। 
সে তো অনেক কথা। অনেক লিখেছি। 
ছিল তো সবাই। মানে আমাদের চলতি শব্দ 'সব জাতের। তাঁতিরা ছিল। আজ তাঁতিদের কথা। 
অন্যদের কথা পরবর্তী পর্ব গুলিতে। 
ছিল মানে ছিল প্রায় ষাট ঘর। তাই বলতেন পুরনো মানুষরা। ষাট ঘর! সোজা কথা নয়। 
নয় তো বটেই। 
 আসলে আমি ভাবছি এরা কি আদি থেকেই এই গাঁয়ের মানুষ। না কি অন্য জায়গা থেকে এসে এখানে তারা বসতি স্থাপন করেছিলেন। 
নদীর ওপারে ইলামবাজারের চৌপাহারী জঙ্গল যেখান থেকে আরম্ভ হচ্ছে সেখানে, অর্থাৎ এখনকার সুখবাজারে  রায়পুরের সিংহ বাবুরা এখানে তাঁতিদের এনে বসিয়েছিলেন। তাহলে কি অজয় পার হয়ে এখনকার সাতকাহনিয়া বা অযোধ্যা গ্রামেও তাঁতিদের বসিয়েছিলেন। হওয়া খুবই সম্ভব। 
 রায়পুরের সিংহ বাবুরা সুরুলের চীপ সাহেবের সাথে ব্যবসা করে বিশাল ধনী হয়েছিলেন। 
মেদিনীপুর এর চন্দ্রকোনা এলাকা থেকে শোনা যায় হাজার ঘর তাঁতি দের তাঁরা ওখান থেকে নিয়ে এসে এখানকার নানা গ্রামে তাদের বসতি গড়ে দিয়েছিলেন। ভাবলে কেমন লাগে। হাজার ঘর তাঁতি দেশ মাটি ছেড়ে এখানে এলেন। নিশ্চিত ভাবেই ভালো কিছুর আশায়। হাজার ঘর তাঁতি 
প্রতিদিন বোনেন' গড়া' কাপড়ের থান। গড়া কাপড় হচ্ছে ঠাসবুনোট, মোটা কাপড়। নৌকোর পাল হতে পারে আবার আজকের জিন্সের মতো 
সৈনিক দের পোষাক হত সেই কাপড়ে। 
ধবধবে সাদা করার জন্য ছিল অনেক ঘর ধোবা। 
এখনকার শান্তি নিকেতনের বিনয় ভবনের মাঠে ছিল ধোবাদের পাড়া। এখনও লালবাঁধে ধোবারা 
কাপড় ধোয়। সেই কাপড় কে ধবধবে সাদা করার জন্য চাই নীল। সুরুলের চীপ সাহেবের বিশাল, কুঠিবাড়ি। ছোট খাটো দুর্গের মতো চারপাশে ইঁটের প্রাচীর। 
জলাশয়, বাগান, বিশাল বিশাল সুন্দর খিলানের অনেক ঘর। একতলা, দোতালা। এই চীপ সাহেবই বীরভূমের প্রথম কমার্সিয়াল রেসিডেন্ট হয়ে এসেছেন। সিভিল সার্ভিস থেকে। বড়লোকের ঘরের ছেলে। মানুষ টিও ভালো। অন্য নীলকর দের থেকে তিনি আলাদা। 
সুরুলের সরকার বাবুরা-ও এই চীপ সাহেবের সাথে প্রথমে গড়া কাপড়ের ব্যবসা করেই বিরাট ধনী হয়েছেন। বানিয়েছেন দুর্গাদালান সমন্বিত বিশাল দোতলা চকমেলানো প্রাসাদ। সে তো অনেক কথা। 
রায়পুরের সিংহ বাবুদের জমিদারী ছিলো ইলামবাজার এলাকায়। ছিল তাঁদের বিরাট কাছারিবাড়ি। গুদামঘর। হাজার ঘর তাঁতি 
প্রতিদিন হাজার খানা গড়া কাপড়ের থান তাঁদের 
সরবরাহ করেন। আর সিংহ বাবুরা সেই হাজার খানা কাপড় সাপ্লাই করেন চীপ সাহেবকে। 
মাঝখানে তাঁদের আয় হয় প্রতিদিন হাজার টাকা। 
কমকথা নয়। তখনকার দিনে হাজার টাকা। 
তখনকার দিন মানে মোটামুটি দুশো বছর। 
চীপ সাহেব সুরুলে এসেছিলেন ১৭৮২  সালে। 
রায়পুরের সিংহ বাবুরা 
সুরুলের সরকার বাবুরা-ও কাছাকাছি সময়ে। 
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি। 
বাবুদের কথা বলতে হলে অনেক কথা বলতে হবে। সেও না হয় হবে। 
এই গাঁয়ে আজ আর একঘর তাঁতি ও নাই। 
অযোধ্যা গ্রামে অনেক গুলি তাঁতি পরিবার। 
কোন ঘরেই অবশ্য তাঁত চলেনা। এখানের শেষ তাঁত বুনেছেন অযোধ্যার শ্যামবাজার অংশের 
বংশী শীল। আর অযোধ্যায় সম্ভবত কমল তাঁতি। পদবি দে। অযোধ্যা গ্রামে তাঁতিদের মধ্যে 
 দালাল পদবীর দুটি পরিবার ছিল। এই দালাল রা 
দালালী ই করতেন। তাঁরা স্বাভাবিক ভাবেই ধনী হয়েছিলেন। তাঁরা নিজেরা তাঁত বুনতেন না। 
লোক নিয়োগ করতেন। সব তাঁতিদের ঘর থেকে পাইকারি হারে কাপড় কিনে রায়পুরের সিংহ বাবুদের কাছে সরবরাহ করতেন। মাঝ খানে তাঁদের লাভ হত ভালোই। একটি দালাল পরিবার অবশ্য তাঁত বুনতেন তাই নয় শাড়ির পাড়ে ভালো নক্সা তুলতে পারতেন। তিনিই ছিলেন -
তাঁত প্রায় সব ঘরেই ছিল। ভালো গামছা বুনতেন কেউ। রেশম, তসর ও বুনতেন তাঁরা। 
সুরুল থেকে বা রাজনগর, তাঁতিপাড়া থেকে তসর, রেশম সুতো নিয়ে আসতেন। 
 এখানে সাদা সুতোর রঙ করে নিতেন। মোটামুটি 
পঞ্চাশ - ষাট বছর আগেও তাঁরা  ছিলেন। 
অযোধ্যা গ্রামে চেষ্টা হয়েছিল তাঁতিদের নিয়ে সমবায় গড়ার। তাঁতঘর তৈরী হয়েছিল। ভালো উন্নত মানের তাঁত আনানো হয়েছিল। এই সমবায় সমিতির উদ্যোক্তা ছিলেন প্রয়াত নারায়ণ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সহ তাঁর সময়কালের বিশিষ্ট মানুষরা। 
যদিও তাঁত বাঁচেনি। যে উদ্দেশ্য নিয়ে সমবায় সমিতি গঠিত হয়েছিল - সেই উদ্দেশ্যও  সফল হয়নি। এখন সেখান থেকে শুধু রেশন বিলি হয়। 
আমার মনে হয় সামগ্রিক ভাবে সমবায় আন্দোলন টাই মুখ থুবড়ে পড়েছে অনেক দিন আগেই। 
যাই হোক আমাদের কথা হচ্ছিল পশ্চিম বর্ধমান জেলার, কাঁকসা থানা এলাকার অযোধ্যা বনকাটি এলাকার, সাতকাহনিয়া, অযোধ্যা গ্রাম নিয়ে। 
অযোধ্যা গ্রামের তাঁতিরা সচ্ছল ই ছিলেন। পুকুর কাটিয়েছেন।  তাঁতি পুকুর নামেই তার পরিচয়। 
আমবাগান তৈরী করেছেন। অযোধ্যা গ্রামের উত্তরে বিশাল আমবাগান এই সেদিনও ছিল। 
তার পশ্চিম দিকের বাগান টি তাঁতিদের। 
সাতকাহনিয়ার তাঁতিরাও আম বাগান তৈরী করেছিলেন। একেবারে নিজেদের বাস্তু ভিটার কাছাকাছি। গ্রামের উত্তর পশ্চিমে। বিরাট এক পুকুর, নাম গোলামপুকুর। কোন এক গোলাম নিশ্চয়ই কিনে নিয়েছিলেন। গ্রামের পশ্চিম দিকে 
মুসলিম দের বাস। তাঁরা এসেছেন মোটামুটি - বছর আগে। তখন পুরনো গ্রামের ভগ্ন দশা। 
গ্রামের পূর্ব দিকের বিরাট আমবাগান। একদিন ছিল অধিকারী ব্রাহ্মণ দের। পরে বিক্রি হয়ে যায়। 
মুসলিম আর তাম্বুলী সম্প্রদায়ের হালদার পরিবার কিনে নেন। 
অধিকারী রা এই গ্রাম পরিত্যাগ করেন। অন্যদের দাপটের ভয়ে। 
তাঁতিরা যে কে কোথায় গেলেন। অনেকে যে মারা গিয়েছেন তাতে সন্দেহ নাই। কেননা মারাত্মক কলেরা, প্লেগ,এক ধরনের ম্যালেরিয়া, যার নাম বর্ধমান জ্বর আছড়ে পড়েছিল সমগ্র এলাকাতেই। 
অনেকে মারা গেছেন। আর যাঁরা বেঁচে ছিলেন তাঁরা যে যেদিকে পেরেছেন পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন। জমি, পুকুর, বাগান যা যেটুকু ছিল জলের দামে হয় বেচে দিয়ে গেছেন। কিম্বা অন্যরা 
যাঁরা তখন প্রভাবশালী হয়েছেন তাঁরা দখল করে নিয়েছেন। 
এই গ্রামে এক সৈয়দ বংশীয় সুফি সাধক, সৈয়দ শাহ তকী সাহেবের পুত্র সৈয়দ শাহ আলী জাওয়াদ, খুষ্টিগিরি থেকে এই গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। আনুমানিক - বছর আগে। 
তিনি ইউনানি চিকিৎসা ভালো জানতেন। বর্ধমানের রাজার মারাত্মক পিত্তশূল ভালো করে দিয়ে রাজাদের কাছ থেকে অনেক ভূসম্পত্তি লাভ করেন। অনেকে বলেন প্রায় সাতশো বিঘা, মতান্তরে চোদ্দশো বিঘা। সেই জমি চাষ করাবার জন্য এবং নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বিহার, ঝাড়খণ্ড থেকে নিয়ে আসেন জোলা মোমিন মুসলমানদের। যাঁদের পূর্ব পুরুষরা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। ছিলেন সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ। 
ইংরেজ দের সাথে এই সৈয়দ বংশীয় দের খুবই সুসম্পর্ক ছিল। 
গোলামপুকুরের আগের নাম কি ছিল তা জানা যায়না। কিন্তু আমার দৃঢ় অনুমান অন্য নাম ছিল। 
অসম্ভব নয় এটা তাঁতিদের কাটানো। নাম তা হলে হওয়া উচিত তাঁতিপুকুর। 
কেননা এই পুকুরের উত্তর পশ্চিম পাড়ে বাস ছিল তাঁতিদের। পুকুরের উত্তর পাড়ে লম্বা লম্বা তালগাছের সারি। একটা চারআঁটির কালো কুচকুচে, খুব মিষ্টি তালের গাছ। সেই তাল কুড়োবার জন্যে আমাদের দীর্ঘ অপেক্ষা থাকত। 
তাঁতি বাগান  যে বিরাট ছিল তা নয়। কমবেশী কুড়ি পঁচিশ টা আম গাছ। 
তাদের মধ্যে সেরা আমগাছটি ছিল বিরাট মহীরুহ। আর তার ফল ছিল অপূর্ব স্বাদ গন্ধের 
' খইনাড়ু ' আম। একেবারে নাড়ুর মতো গোল তার ফল। সেই আম কুড়োবার কি ধূম না ছিল। 
কাছেই কোঁড়া পাড়া। তারাই কুড়িয়ে নিত। আমরা দু চারটে পেতাম। আহা, কি অপূর্ব ছিল সেই আম। 
এই গ্রামের তাঁতিপাড়া, বা তাঁতি বাগানের সর্বশেষ জীবন্ত প্রতিনিধি ছিল সেই আমগাছটি। 
অন্যরা আগেই গেছে। হালদার বাবুরা কেটে বিক্রি করছেন। 
আমরা তখন ছোট। ভাবতাম নিশ্চয়ই এই গাছটাতে কেউ হাত দেবেনা। পুকুরের উত্তর পাড়ের তালগাছ গুলো আর একটাও নাই। 
অন্যান্য গাছ বলতে ছিল বেশ কয়েকটা খেজুর, 
কয়েত বেল , পলাশ সেসব ও পরিষ্কার হয়ে গেছে। 
 বাবুরা  এক এক করে সব  বেচে দিয়েছেন। 
বাকী ছিল এই বিশাল আমগাছ টি। 
তারপর একদিন তারা এলো। গাছ কাটা দের দল। 
তাঁবু পাতল কাছেই। রান্না বান্না, থাকা খাওয়ার জন্য। দড়ি, দড়া, বিশাল লম্বা লম্বা করাত। 
দাঁত গুলো তাদের চকচক করছে। 
গাছটির মোটা মোটা শাখা প্রশাখা গুলি আগেই কাটা পড়ল। সারা দিনরাত করাতের ঘ্যাসঘ্যাস আওয়াজ। 
আমাদের মাটির দোতালা নীচু ঘরের উপর কোঠায় ছোট্ট জানালার ধারে পড়তে বসি। রাতে সামনে হ্যারিকেন। ডালপাল গুলিকে টুকরো টুকরো করা হচ্ছে। করাতের নির্মম শব্দ। সামনে হ্যারিকেন জ্বলে। বই খোলা থাকে। পড়া হয়না। 
কানে বাজে শুধু করাতের শব্দ। আমার ছোট মনে কেবলই পাক খায় ' কেন কাটল, কেন কাটল এই 
আমগাছটিকেও। তখন কি আর বুঝি বাবুদের অনেক টাকার দরকার। এখনই কেটে বেচে দাও। কি জানি পরে কি হয়! সময়কাল সত্তরের দশকের প্রথম ভাগ। চারদিকে চলছে বৃক্ষ নিধন যজ্ঞ। বাবুরা সব বেচে দিচ্ছেন। বাবুদের বড় লোভ। 
তারপর একদিন তার গুঁড়ি তে করাত চলল। দড়ি দড়া বেঁধে টান দেওয়া আছে উত্তর দিকে। 
 কত মানুষের নানা কসরত। গাছ কাটার নানা কায়দা কানুন আছে তো। 
বিশাল আর্তনাদ করে সে একসময় ভূপাতিত হল।
 গিয়ে দেখলাম। পড়ে আছে তার কাটা দেহ। 
আর গুঁড়ি থেকে বের হচ্ছে লাল রস নয়, যেন টকটকে লাল রক্ত। 
তাঁতিবাগানের শেষ প্রতিনিধি কে নির্মম ভাবে হত্যা করা হল। শুধু আমাদের কারও কারও মনে হয়তোবা  রয়ে গেছে সেই ' তাঁতি বাগান ' আর তার সেরা ' খই নাড়ু আমগাছ ' টি কে। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ 

 কথা - সাতকাহন।  আমবাগান  , তালসারি অধ্যায় 
ছবি। অন্য এক গ্রামের পুকুরপাড়ে তাল গাছের সারি। এমনটাই ছিল এই গ্রামেও।

চলুন ঘুরি চারপাশ। মেলা দেখা তার সাথে একটা হেরিটেজ ট্যুর

।। মজাটা কি জানেন।। 
 মজাটা এখানেই যে যতই শপিং মলে যাই,মেলার এক আলাদা আকর্ষণ আছে। মেলা মেলাই। মেলার বিকল্প মেলা। মানুষে মানুষে মেলা। মেলার মাল বলে  কেনাকাটা হয়তো তেমন করিনা।  আবার দেখুন শান্তি নিকেতনে এলে সোনাঝুরি র হাটে যাওয়া, কেনাকাটা করায় বেশ মজা। 
 আমাদের আনন্দ কিন্তু হাটে, মেলায়, ফুটপাতের কেনা কাটায়। গড়িয়াহাটের ফুটে কি না পাওয়া যায়। যে ক্যানভাসের থলি টা পঞ্চাশ টাকায় কিনতে পাওয়া যায় 
সেই ধরনের , পাতলা মার্কিন কাপড়ের থলে, । এই ধরুন ছোট খোকা বলে অ, আ। হামাগুড়ি দিচ্ছে বাচ্চাটা। নন্দলালের বিখ্যাত আঁকা। তার প্রিন্ট
আছে ব্যাগের উপরে। নন্দন মেলায় তার দাম  দেড়শ দুশো টাকা। বলে দিলেই হচ্ছে। নন্দন মেলা বলে কথা। এসেছেন না কি নন্দন মেলায়। হয় ডিসেম্বরের ১ এবং ২ তারিখে। 
 এখানে দামটা বড় নয়। মেলার স্মারক। কিন্তু আমরা অনেকে কিনতে পারিনা। ক্যালেন্ডার, কিছুই নাই, একটা আঁকাও  পছন্দ না হলেও তার দাম দুশো, আড়াইশো। কি করে কিনব। ইচ্ছে থাকলেও পারিনা। শান্তিনিকেতনের মেলায় জিনিসের বড়ো দাম। অনেকে বলেন। আমিও বলি। মেলা দেখা নিশ্চয়ই হয়ে গেছে। তবে চলুন। 
আর কেন এসব নিয়ে কচকচ করা - 

 যাক এসব কথা বাদ দিন। আসি অন্য কথায়। 
শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা দেখতে এসে চারপাশে একটা হেরিটেজ ট্যুর সেরে অনেকে ফেলেন। নিজেদের গাড়ি থাকলে কথাই নেই। তা না হলে অটো, টোটো, ভাড়া গাড়ি। যে যেমন পারে টাকা নিয়ে নেয়। 
 একটা রেট থাকা দরকার। আমাদের সকলেরই মনোভাব, আরে বাবা , ঠিক আছে, বছরের এই সময়টা তো মাত্র। দু পয়সা বাড়তি রোজগার করুক 
 সুরুল সরকার জমিদার বাড়ি,রাইপুর সিংহ বাবুদের ভগ্ন প্রাসাদ, সুরথেশ্বর শিব তলা হয়ে, বিশ্ববাংলা কে পাশে রেখে সুপুরের টেরাকোটা অলংকরণ যুক্ত মন্দির, করে ইটাণ্ডা পর্যন্ত অনেকে সেরে ফেলেন। এই সব স্থানের তো অনেক গল্প কথা আছে। আছে ইতিহাস। ইতিহাস টা জানা থাকলে 
বেড়ানো  আনন্দ টা  বেড়ে যায়। আর আমি বা আমাদের মতো আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চাকারী রা চাই 
আপনারা ইতিহাস টা জানুন। সব মাটির নিজস্ব ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস উপেক্ষার নয়। 
মাটিকে না জানলে মানুষ কে চেনা যাবেনা। 
যাক। এই হল আমার শুরুর কথা। সারা জীবন এই কাজ করে গেলাম। কোন প্রাপ্তির আশা ছাড়া। 
যদি এই সব স্থানের কথা কাহিনী শুনতে চান তবে আমাকে ফলো করবেন। 
আজ তবে ইটাণ্ডার কথা বলি। শুদ্ধসত্ত্ব বাবু বলেছেন। 
 তাঁকে ধন্যবাদ। আমার সাথে এগারো মাইল থেকে 
মেলা পর্যন্ত এসেছেন। চলুন যাওয়া যাক ইটাণ্ডা। 
 
 ।।  ইটাণ্ডা র কথা ও কাহিনী।। 
 নদী সরে গেছে অনেক দক্ষিণে। নদীপাড়ে অঢেল সব্জি। 
 উর্বর পলি মাটি। একদা এই নদী বইত উত্তরে বাজারের গা ঘেষে। কত মালের ওঠানামা। নীল, গালা,  সুতী বস্ত্র ( গড়া কাপড়)  হাড়ের চিরুনি, মশলাপাতি, পিতল কাঁসার তৈজস পত্র প্রভৃতি দ্রব্যাদি সওদাগরি নৌকায় চেপে চালান যেত নানা জায়গায়। ইটাণ্ডা ছিল এক নদী তীর বর্তী জমাট বাণিজ্য কেন্দ্র। বলছি নদী কিন্তু নদ। অজয়। 
 তখন কোথায় বোলপুর! 
 অনেকে বলেন  ইষ্ট ইণ্ডিয়া র অপভ্রংশ ইটাণ্ডা। 
 তাহলে কি তার আগে ইটাণ্ডা ছিলনা। বা কি ছিল তার নাম! প্রশ্ন জাগে। 
 তখনকার বিখ্যাত  জায়গা সুপুর,  সুরুল, ইটাণ্ডা। 
 ইটাণ্ডা ছিল অজয়ের দক্ষিণে। বর্ধমানের দিকে। এখন সেই মজা নদীখাত এক নোংরা খাল মাত্র। 
 আজ আর সেই ইটাণ্ডা নাই। ইটাণ্ডার কথা বলার মতো বয়স্ক মানুষ ও হয়তো নাই। 
 একদিনের বনেদী ব্যবসায়ী পরিবারের কর্তা পীযুষ কান্তি  সাধু র সাথে কথা বলছিলাম। এঁরা তো ছিলেন সাধু খাঁ। খাঁ টাকে কখন যে ত্যাগ করলেন। বেণে পরিবার। যথেষ্ট সম্পন্ন, এবং প্রভাবশালী পরিবার ছিলেন নিশ্চিত ভাবেই। খাঁ  উপাধি পেয়েছিলেন। 
 ইটাণ্ডা মন্দির টেরাকোটা প্রেমী দের কাছে খুবই জনপ্রিয়। 
 এখানকার  জোড়বাংলা রীতি র কালীমন্দির এর টেরাকোটা অলংকরণ 
 অনবদ্য। জোড়বাংলা রীতি র এমন মন্দির কমই দেখা যায়। 
 দ্বিতল বিষ্ণু দালান। তার স্তম্ভে খিলানে ঐশ্বর্য। আর অতি চমৎকার  কলমকারি র ( স্টাকো) কাজ তার দেওয়ালে। 
 উপরের ছাদ ভেঙে পড়ছে। সংস্কার করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনটাই সাধু পরিবারের নাই। নানা শরিকের নানা মত। 
 ১২২২ এবং ১২৩৫ সালে নির্মিত শিবমন্দির দুটি। কালীমন্দির 
 নির্মান ও সমসাময়িক। বিশাল অশ্বত্থ তলে সম্ভবত প্রাচীন কোন নির্মানের উপরে নির্মিত হয়েছিল প্রাচীণ এক মন্দির। 
 অশ্বত্থের মায়া বাঁধনে বাঁধা। বাউরি পাড়ায় একটি ছোট চালা রীতি র শিবমন্দির। একেবারে ই ভেঙে পড়ার অবস্থা। 
  বীরভূমে বর্গীর আক্রমণ এবং অত্যাচার ছিল প্রবল। 
 সিউড়ি র কাছে কেন্দুয়াডাঙ্গায় ছিল তাদের প্রধান ঘাঁটি। 
বারবার তারা ইটাণ্ডা কে লুঠ করেছে। 
 এক জোড়াল খাঁ হিন্দু মুসলমান সকলকে একত্রিত করে 
মাটির গড় বানিয়ে, সৈন্য দল তৈরি করে বর্গী আক্রমণ প্রতিরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিন বারের লুঠে ইটাণ্ডা তার হৃতগৌরব আর ফিরে পায়নি। অনেক ব্যবসায়ী এখান ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। 
 সুপুরে ও আনন্দ চন্দ্র গোস্বামীও বর্গী দের রুখে দিয়েছিলেন। 
  ১২০০ বঙ্গব্দের আশেপাশে র সময় কাল দুর্যোগের ঘনঘটায় 
 আচ্ছন্ন।। সেই সময়কাল। ছিয়াত্তর এর মন্বন্তর, মন্বন্তর পরবর্তী  পরিস্থিতি। ডাকাত দলের অবাধ ডাকাতি। বর্গী আক্রমণ , ইউরোপীয় বণিকগন। খুব সং ক্ষেপে তাকে একটা প্রবন্ধে ধরা কঠিন ই কাজ। তবু লিখেছি ছোট কাগজে।   সেই সময়কাল নিয়ে অনেক গুণী মানুষ কাজ করেছেন। তাঁদের সাহায্য ছাড়া কাজ করা যায়না। 
 অজয়ের এপার ওপার  আমার কাজের ক্ষেত্র। আপনারা জানেন। এপারে দক্ষিণে সেনপাহাড়ী আর ওপারে উত্তরে সেনভূম। মাঝে বয়ে চলে অজয়। প্রাচীনা অজাবতী। 
 ------------ ------------- ------------ ------------ ------------ ------------ 
 বোলপুর থেকে সহজেই যাওয়া যায়। বোলপুর পালিতপুর রাস্তার নিমতলা মোড় থেকে দক্ষিণে কয়েক কিমি।
সাথে ছিল - অঙ্কুশ দাস। গবেষক। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।

চলুন যাওয়া যাক গল্প করতে করতে

।। চলুন ফেরা যাক।। 
তাহলে এবার ফিরতে হয়।আর কেন। বেশ হল। ভালোই তো। এসেছিলাম শান্তি নিকেতনের মেলা। আর যদি হয়ে যায় একটু এদিক ওদিক ঘোরা। এই সুরুল, রাইপুর, সুপুর, ইটাণ্ডা, এই সব জায়গায়। বেশ একটা হেরিটেজ ট্যুর এর মতো। 
তো প্রণব বাবুর সাথে গল্প করতে করতে ইটাণ্ডা হল। বেশ ভালো লাগলো। 
শুধু ইটাণ্ডা কেন সবগুলিই হল। নিজেদের গাড়ি ছিল।  ফিরতে তো হবেই। সপ্তাহ অন্ত হল যে। 
 সেই এগারো মাইলে এসে আবার  প্রণব বাবুকে সাথে পেলাম।  এবার ওঁর কথা শুনতে শুনতে চলেছি পানাগড় এর পথে। রাজ্য সড়ক। পানাগড় মোরগ্রাম হাইওয়ে। 
,, আমরা দাঁড়িয়ে আছি সীমান্ত রেখায়। বুঝলেন। 
 এই রাস্তা সীমান্ত। এর পূর্বে, ঐ দেখুন রাস্তা চলে গেছে আদুরিয়া অমরপুর এর হয়ে আরও পূবে। 
থানা - আউসগ্রাম। গুসকরা মোড় থেকে চমৎকার বনপথ চলে গেছে গুসকরা বা ভেদিয়ার দিকে। 
কালিকাপুর মৌখিরা আছে ঠিক এই নীলকুঠীর জঙ্গলের খোয়াই এর নীচে। প্রাসাদ আর মন্দির নগরী। না দেখা থাকলে দেখতেই হবে 
আর ঐ দেখুন রাস্তা চলে গেছে অযোধ্যা বনকাটি হয়ে আরও পশ্চিমে গড়জঙ্গল, ইছাই ঘোষের দেউল পার হয়ে আরও পশ্চিমে। কাজলাডিহি নবগ্রাম , শিবপুর দুর্গাপুর  রাস্তাপর্যন্ত।  পাশে পাশে  অজয়। 
অজয়ের ওপারে মানে উত্তর পাড়ে জয়দেব কেন্দুলী। বেশী দূরে নয় কিন্তু। বীরভূমে। 
কি জানি মেলার সময় এসেছেন কি না। 
এই পথের পাশেই আছে " তেপান্তর নাট্য গ্রাম "
যদি না এসেছেন, একবার এসে নিজের চোখে ই  দেখবেন। বেশী এখানে বলছিনা। 
রাস্তার এপারে মানে পশ্চিমে কাঁকসা থানা। 
অর্থাৎ দুটো থানা এলাকার সীমানা আমাদের এই বড় রাস্তা পানাগড় মোরগ্রাম হাইওয়ে। 
জঙ্গল শুরু হবার আগে বাঁদিকে মাজুড়িয়া গ্রাম। 
আর ডানদিকে রঘুনাথপুর গ্রাম। 
আদুরিয়া। বড়ো আদর করে রাখা নাম। কি বলুন। 
সার্ভেয়ার জেনারেল রেণেল সাহেবের ম্যাপে (১৭৬৯) আদুরিয়ার উল্লেখ আছে। পথ চলে গেছে 
আদুরিয়ার পাশ দিয়ে ভাতকুণ্ডা মানকর হয়ে বর্ধমানের দিকে। 
আর পশ্চিম দিকে সেই রাস্তা সেনপাহাড়ি র ভিতর দিয়ে। এই পশ্চিম প্রান্তের কোন গ্রাম নামের উল্লেখ নাই। একটু অবাক লাগে। গোটা টাই জঙ্গল দেখানো আছে। অজয় পার হয়ে সে রাস্তা চলে গেছে রাজনগর এর দিকে। 
ইছাইঘোষের দেউল আছে। অযোধ্যা বনকাটি র মতো জনপদ আছে। সাতকাহনিয়া আছে। 
গৌরাঙ্গপুর আছে। বা সেদিনও ছিল। মাথা উঁচু করেই ছিল। কেন ম্যাপে কোন স্থান উল্লেখ নাই। আমাকে ভাবিয়েছে খুব। হয়তো তাঁর সহকারী রা 
 উল্লেখযোগ্য নয় ভেবে ভুল করেছেন। 
যাই হোক আমাদের পূব দিকে ঐ যে আদুরিয়া অমরপুর শ্রীচন্দ্রপুর গ্রাম। সম্পন্ন গ্রাম ছিল আদুরিয়া। 
অমরপুর এর পিতল শিল্পের খ্যাতি ছিল খুব। 
দেবী অমরচণ্ডী র নামে অমরপুর। 
পিতলের দ্রব্যের কারিগররা ছিলেন খুবই দক্ষ। 
বিখ্যাত উখরার হাণ্ডা জমিদার বাবুদের পিতলের রথের প্রধান কারিগর ছিলেন রাধাবল্লভ মেহতরী। 
নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হবেনা। এত সুন্দর তার অলংকরণ। 
কবিরাজ রা খুবই ধনী ছিলেন। ঝুড়ি ভর্তি মোহর 
জলে ধুয়ে ছাতে রোদে শুখুতে দিতেন 
গোটা পাড়া জুড়ে ছোট ছোট চালা রীতির শিবমন্দির। আবার পাশাপাশি মুখোমুখি দুটি 
শিখর দেউল শিবমন্দির। আর ছিলেন বিষ্ণু। 
এক পরিবারে নৃসিংহ দেবতার ক্ষোদিত মূর্তি পূজিত হন। মিলিত ভাবে অমরপুর আদুরিয়া
ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ এক গ্রাম। 
মাজুড়িয়ার কথা। জুড়ি নাই যার। টোল শিক্ষার কেন্দ্র ছিল। 
রঘুনাথপুর সম্পন্ন গ্রাম ছিল। 
রঘুনাথপুর থেকে ঐ যে পশ্চিমে পিচ রাস্তা চলে গেছে মলানদিঘী হয়ে দুর্গাপুরের দিকে। মলানদিঘী এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। 
কেন গুরুত্বপূর্ণ! বলতে গেলে আরও একটু সময় লেগে যাবে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এবং পেশগত শিক্ষার নানা প্রতিষ্ঠান এখানে গড়ে উঠেছে।
রঘুনাথপুর এর জঙ্গল বড় নয়। পার হয়ে এলাম। 
বাঁদিকে বেলডাঙা গ্রাম। ব্যতিক্রম। এ গ্রাম আছে 
বড় রাস্তার পূর্বে। এই বেলডাঙা থেকে রাস্তা চলে গেছে ধানতোড় কে পাশে রেখে ছোট রামচন্দ্রপুর, আড়জুড়ি, তিলং, রাঙাখুলা। আপনাদের মনে হবে বড়রাস্তা থেকে এত ভিতরে এই সব গ্রাম আছে! যাইহোক 
এবার পিয়ারীগঞ্জ, আর পশ্চিমে তেলিপাড়া। 
বর্ধমানের এক রাণী প্যারীকুমারী র নামে পিয়ারীগঞ্জ। পুরনো গ্রামে অনেক শিবমন্দির ছিল। 
তেলিপাড়া। তাবলে তেলিদের গ্রাম নয়। তেলিরা আছেন বটে। গাছতলায় আছেন দেবী তিলাইচণ্ডী 
বা তিলুইচণ্ডী। সেখান থেকে তেলিপাড়া। 
এই দেখলেন, কখন হুস করে পেরিয়ে গেছি ছোট্ট কুনুরের সেতু। ছোট্ট কুনুর এখানে একটা নালার মতো। কিন্তু আরও নীচে বেশ চওড়া। অতিবৃষ্টি হলে ভাসায়। এমনকি গুসকরা শহরের  নীচু এলাকা জলমগ্ন হয়। এই গুসকরা শহরের উপর দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা চলে গেছে। গরম সামান্য বেশী অনুভূত হয়। 
দোমড়া। দুই মোড়ের জায়গা। আবার কেউ বলেন ডোম রা। এখানের বৈষ্ণব আশ্রম টি প্রাচীণ। 
গ্রামের ভিতরে আছে একটি শিবমন্দির। বাইরে একটি চাঁদনী রীতির বিষ্ণু দালান। এখানেরামকৃষ্ণ আশ্রমের শাখা কেন্দ্র আছে। 
বর্ধমানের রাজা ত্রিলোক চন্দ্রের নামে গ্রামের নাম ত্রিলোকচন্দ্রপুর। অনেক বিশিষ্ট, সম্পন্ন পরিবার এখানে আছেন। পাল পরিবারের খ্যাতি ছিল নানা ব্যাধি উপশমের জন্য আয়ুর্বেদিক তেল তৈরী তে। 
পূর্ব দিকে রাস্তা চলে গেছে দেবশালা হয়ে মানকরের দিকে। দেবশালার প্রাচীন নাম রাজগড়। তার মানে বুঝতেই পারছেন যে একটা গড় ছিল। তাবলে এ গড় রাজস্থানের দুর্গ নয়। 
মোটা ইঁটের প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। 
রাজগড়ের অনেক গল্প কথা। পরে হবে। আচ্ছা আপনারা কাগজে হয়তো লবনধার গ্রামের নাম শুনেছেন। ভুল ভাবে বলা হচ্ছে আল্পনা গ্রাম। 
আলপনা নয় বরং বলা উচিৎ " চিত্রিত গ্রাম। "
আপনারা যাঁরা শহরে থাকেন তাঁরা ভাবতেই পারবেন না ঐ মাঠ, জঙ্গলের ওপারে এমন সব সম্পন্ন, সমৃদ্ধ গ্রাম আছে। 
যাই হোক শুরু হল ধোবারুর জঙ্গল। এই জঙ্গল কে বলা হয় " সাতকাটার জঙ্গল "। সেই সময়ে মানে মাত্র দুশো বছর আগে জঙ্গল ছিল জঙ্গলই। 
আর চোর, ডাকাত, রাও ছিল। এই জঙ্গল ই তো ছিল তাদের ডেরা। কার বা কাদের হাতে সাতজন কাটা পড়েছিলেন। তার কোন নথি নাই। 
অনুমান বৈদেশিক আক্রমণের মুখে পড়ে কাঁকসা রাজবংশ ধ্বংস হয়। সৈয়দ বুখারী ছিলেন তাঁদের নেতা। প্রবল যুদ্ধের শেষে কাঁকসা পরাজিত হয়। 
সেই সময়ের ঘটনা হবার সম্ভাবনা বেশী। রাজবংশের সাত সৈনিক বা পাহারাদার, বা সেনাপতি বা রাজবংশের সাত ব্যক্তি যাঁরা হয়তো যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন, তাঁরা অতি দ্রুতগামী অশ্বের সামনে দাঁড়াতে পারেননি। নিহত হয়েছিলেন। 
এই আমাদের এখনকার কাঁকসা থানা এলাকা সেদিনের পরগণা সেনপাহাড়ী। সেন রাজাদের পূর্ব পুরুষ রা এসে গড়জঙ্গলের গভীরে সম্ভবত রাজা 
কর্ণসেনের আশ্রয় নিয়েছিলেন। কর্ণসেন ছিলেন পাল রাজাদের সামন্ত। মেদিনীপুর এর ময়নায় ছিল তাঁর আসল রাজত্ব। তিনিও দক্ষিনী। সেন রাজাদের বাঙ্গলায় আদি বাসস্থান হিসাবে এই এলাকার নাম হয়ে যায় 
" সেনপাহাড়ী "
চলুন, প্রায় এসে গেছি। জঙ্গলের ভিতরে ভিতরে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের রাস্তা,রানওয়ে,  নানা নির্মান। একটু দূরেই বিমানঘাঁটি। 
রেল লাইন স্থাপনা কে কেন্দ্র করে পানাগড় বাজারের গড়ে ওঠা। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে 
আদি জি টি রোড। 
কাঁকসা প্রাচীণ জনপদ। রাজা কঙ্কসেন - কনকসেন থেকেই কাঁকসা নাম এসেছে। এই এক মত। আর এক মত কাঁকসা তাঁদের পদবী। 
যেমন ভবানীপতি কাঁকসা। তাঁর নাম থেকে কাঁকসা। 
এসে গেছি পানাগড় রেলস্টেশনে। 
এবার ট্রেন আসার দেরি আছে। বসে বসে মনে মনে এঁকে ফেলুন ছবি। সাল ১৮৫৫। রেল চালু হল হাওড়া থেকে রাণীগঞ্জ। পানাগড় স্টেশন হল। 
আজকের স্টেশন রোড হল মাটি মোরামের রাস্তা। 
চলে গেছে কাঁকসা ডাকবাংলোর পাশ দিয়ে উত্তরে এগারোমাইল, ইলামবাজারের দিকে। 
দাঁড়িয়ে আছে গোরুর গাড়ি। খড় চিবুচ্ছে বলদ দুটো। গাড়োয়ান জল খেতে গেছে পাকুড়তলার ময়রাদের দোকানে। ভালো বাতাসা, কদমা, মণ্ডা পাওয়া যায়। 
বেশ আসুন। আবার আসবেন। এবার যখন আসবেন এই গোটা এলাকা টা চক্কর দেবেন। 
আর যদি আমাকে সঙ্গে পেয়ে যান। "
–------------ ------------ ------------ ------------ 
------------ ------------ ------------ ------------ 
©  প্রণব ভট্টাচার্য। 
হ্যাঁ, একটা কথা বলে নিই। প্রণব বাবুর লেখা একটা ছোট্ট বই আছে। ইলামবাজার কে কেন্দ্র করে কুঠিবাড়ি ভিত্তিক সেদিনের নীল গালা সুতী বা রেশমের  ব্যবসা 
নাম।  এলেমবাজার নিলামবাজার ইলামবাজার। দাম মাত্র দুশো টাকা। 
অক্ষর যাত্রা প্রকাশনীর আনন্দগোপাল হালদার কে ফোনে অর্ডার দিলেই বাড়িতে বসে বই টি সংগ্রহ করতে পারেন। 
ফোন নং 9474907307 
কেন বললাম, না এখানে ইলামবাজার, দ্বারোন্দা, সুরুল, রাইপুর, সুপুর সবার কথা এই বইয়ে আছে। 
পড়ে দেখবেন। আশা করি ভালো লাগবে। অনেক তথ্য আছে। এপার ওপার অজয়ের দুপারের কথা ই আছে। 
-----* আপনারা কিনে পড়লে দ্বিতীয় সংস্করণ টি 
 করতে পারি।   নমস্কার । 
গল্প শুনছেন। "  সেনপাহাড়ীর কথক ঠাকুর " কে কিছু দক্ষিণা দেবেননা!! 
বছর শেষ। আজ ৩১ শে ডিসেম্বর। ২০২৫ এর শুভেচ্ছা কামনা করি। সবাই ভালো থাকুন।। 
এই পর্যায়ের আরও দুটি পর্ব ও৷ পড়ুন। 
আমি তো গল্পবলিয়ে। 
------------ ------------ ------------ ------------