।। সম্প্রদায়ের ৪৬ তমনিম্বার্ক কুলগুরু ঃ স্রী জয়দেব গোস্বামী।।
মধুরকান্তপদাবলী, গীতগোবিন্দম এর রচয়িতা কবিবর
শ্রী জয়দেব গোস্বামী, নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের এক শাখার আচার্য্য কুলগুরু, হিসাবে পরিগণিত হয়েছিলেন।
নিম্বার্ক সম্প্রদায় কে প্রাচীণতম বৈষ্ণব সম্প্রদায় বলা যেতে পারে এই কারণে যে ৭ ম শতাব্দী তে এর উদ্ভব। সময়কাল নিয়ে যদিও বিতর্ক আছে। অনেকে ১২ শতাব্দীর বলেছেন। কেউ ভুলবশতই ১৩ শতকের বলেছেন। অধিকাংশ পণ্ডিতের মতানুযায়ী নিম্বার্ক সম্প্রদায়ই প্রাচীণতম বৈষ্ণব সম্প্রদায়।
সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা নিম্বাকাচার্য ছিলেন তেলেগুভাষী,
যোগী, দার্শনিক, জ্যোতিষী ।
তিনি বৈদূর্যপট্টনম বা বর্তমানের মুঙ্গি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বর্তমান পূর্ব মহারাষ্ট্রে।
পিতামাতার নামও পাওয়া যায় পিতা - অরুন ঋষি, মাতা জয়ন্তী দেবী
তাঁরা সপরিবারে মথুরায় আগমন করেন এবং সেখানেই নিম্ববনে বসতি স্থাপন করেন। মথুরা - বৃন্দাবনের বৈষ্ণবীয় আধ্যাত্মিক পরিমন্ডলে ই নিম্বার্ক স্বামীর আধ্যাত্মিক চেতনা লাভ। এবং দ্বৈত - অদ্বৈত ( dualistic non dualism) মতবাদ প্রচার। তাঁর অনুগামীরা ই হলেন নিম্বার্ক সম্প্রদায়।
এর আরও নাম আছে হংস সম্প্রদায়, সনকাদি, কুমার, হামসা। শ্রী হংসনারায়ন কে এঁরা প্রবর্তক হিসাবে গন্য করেন।
হংস ভগবান, সনকা / সানাকা, সানন্দন, সনাতন, সনৎ কুমার এঁরা ই চার কুমার। এঁরাই হচ্ছেন সম্প্রদায়ের পূর্বসুরী।
বৈষ্ণবধর্মের যে চারটি ধারা, ব্রহ্ম সম্প্রদায় - আচার্য মাধবাচার্য, লক্ষ্মীসম্প্রদায় - আচার্য রামানুজ, কুমার সম্প্রদায় - আচার্য নিম্বার্ক, এবং রুদ্র বা শিব সম্প্রদায়ের বিষ্ণুস্বামী /শুদ্ধ দ্বৈতাচার্য।
যুগল সাধনা এই সম্প্রদায়ের প্রধান সাধনরীতি। রাধা কে কৃষ্ণের থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন করা যায়না। রাধা কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। যে কৃষ্ণ বিশ্বকে মন্ত্রমুগ্ধ, মোহিত করেন, সেই কৃষ্ণকে রাধা যিনি তাঁর প্রেম মায়া দিয়ে কৃষ্ণকে নিয়ন্ত্রণ করেন। রাধা তাঁকেও মন্ত্রমুগ্ধ করেন। অতএব তিনি পরম দেবী। আরাধ্যা।
শ্রী কৃষ্ণ ই সুখস্বরূপ। রাধা তাঁর অবিচ্ছেদ্য অংশ। হ্লাদিনী শক্তি। রাধা কৃষ্ণ মাধুর্য আস্বাদনেই সুখ পান। উভয়েই তখন
একত্রে চিত্তসুখ ভোগ করেন।
এঁদের ধ্বনিনামগানে তাই " রাধে কৃষ্ণ রাধেকৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ রাধে রাধে। রাধে শ্যাম রাধেশ্যাম, শ্যাম শ্যাম রাধে রাধে।। "
আমাদের কবি জয়দেব কবিকে বোধহয় কোন সম্প্রদায়ের গণ্ডীর মধ্যে বাঁধা যায়না। তিনি সকলের। আউল, বাউল, সাঁই
সতুয়া, সকলের। তিনি যোগী, কায়াসাধক, পঞ্চোপাসক, নাথ যোগী, সহজ সাধক।
বুদ্ধকে তিনি দশাবতারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করলেন।
কথিত আছে যে যৌবনে তিনি অজয়ের ওপারে, দক্ষিণে
বিদবিহারের বৌদ্ধ মঠে সাধনার জন্য যেতেন। সাধনার জন্য সেনপাহাড়ী তে যেতেন। আসলে তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক মার্গের এক পরিব্রাজক।
তিনি " পদ্মাবতী চরণ চারণ চক্রবর্তী "
" কেন্দুবিল্ব সমুদ্রসম্ভব রোহিনী রমন "
তিনি " আধুনিক আর্যভাষার আদিকবি "
" বাঙলার কবি, জয়দেব কবি কান্ত কোমল পদে
করেছো সুরভি সংস্কৃতের কাঞ্চনককোনদে। "
" যদি হরিস্মরনে সরসং মনঃ
যদি বিলাসকলাসু কুতুহলম
মধুরকোমলকান্ত পদাবলীং
শৃণু তথা জয়দেব সরস্বতীম।।
কবি জয়দেব প্রৌঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্তে বৈষ্ণব তীর্থ বৃন্দাবনে চলে
গেলেন। একজন বৈষ্ণবের পক্ষে বৃন্দাবনের প্রতি আকর্ষণ স্বাভাবিক। যদিও কবির বৃন্দাবন জীবন নিয়ে বিস্তৃত কিছু জানা যায়না। তবুও তিনি যে সেখানেই নিম্বার্ক সম্প্রদায়ে যোগ দান করলেন এমন অনুমান অসঙ্গত হবেনা। গভীর সাধন মার্গে প্রবেশ করে ধীরে তিনি সম্প্রদায়ের এক জন আচার্য্য হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। এই সম্প্রদায়ের সাধন মার্গের সাথে, তার দর্শনের সাথে, যুগল সাধনার মধ্যে তিনি
নিজের প্রার্থিত পথের সন্ধান পেয়েছিলেন। ক্রমে তিনি হলেন
এই বৃন্দাবনের টাট্টিস্থানের নিম্বার্ক সম্প্রদায় এর এক শাখার
৪৬ তম কুলগুরু।
বৃন্দাবনেই তিনি অত্যন্ত পরিণত বয়সে দেহত্যাগ করেন।
সেখানের টাট্টিস্থান আশ্রমে তাঁর সমাধি আছে।
পদ্মাবতী র কোন সংবাদ পাওয়া যায়না। নিশ্চিত ভাবেই তিনি বিসর্জিতা হননি। কেননা জয়দেবের তিনি যে সাধন সঙ্গিনী।
অনেক উচ্চে তিনি রাধা কে স্থান দিয়েছেন। সময়ের প্রেক্ষিতে
যা অভাবনীয়। তাই তাঁর অন্তরের অন্তস্তল থেকে উৎসারিত হয়েছে " স্মরগরল খণ্ডনং মম শিরসী মণ্ডনং, দেহি পদ পল্লব
মুদারম "। তিনি কি পদ্মাবতী কে ত্যাগ করতে পারেন।
তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে এই সম্প্রদায়ের এক গোস্বামী
রাধারমণ ব্রজবাসী তাঁদের কুলগুরু জয়দেবের জন্মস্থানের
খোঁজে এই বাঙ্গলায় আসেন। বর্ধমানের রাজপরিবারের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন অজয়ের তীরে কেন্দুবিল্ব গ্রামই
কবি জয়দেব গোস্বামীর জন্মস্থান। ইতিমধ্যেই রাজপরিবারের
পক্ষে রাজা কীর্তি চাঁদ জননী ব্রজকিশোরী দেবীর নির্দেশে
জয়দেব কেন্দুলী তে বিরাট রাধাবিনোদ মন্দির নির্মিত হয়েছে। সাল - ১৬০৫ শকাব্দে, বীরভূম জেলা গেজেটিয়ার অনুযায়ী। অন্য মতে ১৬৯৪/৯৬ সালে ৷ কথিত যে জয়দেবের অভিজনদের বাস্তুভিটার উপরেই
এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল। বিরাট নবরত্ন মন্দির। এবং অসাধারণ তার টেরাকোটা অলংকরণ। আজও মন্দিরের অভ্যন্তরে পশ্চিম দিকের এক ছোট্ট কুঠুরি কে জয়দেবের জন্মস্থল বলে মনে করা হয়।
রাধারমণ ব্রজবাসী এখানেই থেকে আশ্রম, বা আখড়া বা মঠ স্থাপন করার বাসনা প্রকাশ করায় বর্ধমানের রাজা ত্রিলোক চন্দ্র রাজ এস্টেট থেকে অনেক জমিজায়গা দান সহ বার্ষিক
ভোগ, সেবা, অন্নসেবা দানের জন্য নগদ টাকা মঞ্জুর
করেন। বর্তমান যা মোহান্ত অস্থল নামে পরিচিত। অস্থল এই অভিধা অনেক পরের। শুরুতে আখড়া বা আশ্রম পরে মঠ।
রাধারমণ ব্রজবাসী ছিলেন একজন সাধক। পরিণত বয়সে
ভূ-গর্ভস্থ সমাধি গহ্বরে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় প্রাণত্যাগ করেন।
পরবর্তী সময়ে মোহান্ত হন দামোদর চন্দ্র ব্রজবাসী। তিনি এক বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। ঘোড়ার পিঠে চেপে জমি জায়গার তদারকি করতেন। চাষি দের কাছ থেকে যাতে ন্যাহ্য ফসল আদায় হয় সেদিকে তাঁর প্রখর দৃষ্টি ছিল। একাধারে প্রায় জমিদার, আবার মোহান্ত। তাঁর সম্পর্কে নানা মত আছে। কেউ বলেন তিনি ছিলেন অত্যাচারী। কেউ বলেন গোপনে ইংরেজ দের বিরুদ্ধে প্রচার করতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী দের সাহায্য করতেন। হাতে বন্দুক নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে এলাকা পরিক্রমা করতেন। স্থানীয় অনেক ভূস্বামী র সাথে তাঁর বিরোধ ছিল । দুর্বৃত্ত দলের হাতে নদীগর্ভে তিনি
নিহত হন। সে ও এক রহস্য। সেই সময়ের এক আলোড়ন সৃষ্টি কারী ঘটনা।।
দামোদর চন্দ্রের শবদেহ দাহ করা হয়েছিল কদমখণ্ডী শ্মশানে। অস্থি সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
দামোদর চন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত কর্মদক্ষ ব্যক্তি। গ্রামের উন্নতি তে তিনি মনোযোগ দিয়েছিলেন। রাস্তা ঘাটের উন্নতি, পুষ্করিণী খণন, ইত্যাদি কাজ তিনি করিয়েছিলেন। গ্রামে ডাকঘর তাঁর আমলেই স্থাপিত হয়। আশ্রমের আর্থিক অবস্থার প্রভূত উন্নতি তাঁর সময়ে হয়েছিল। এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের তিনি ছিলেন পৃষ্ঠ পোষক।
অত্যন্ত অল্পবয়সে পরবর্তী মোহান্ত হন শ্রী রাসবিহারী শরণদেব ব্রজবাসী। তাঁর পক্ষে আশ্রম পরিচালনা করতেন
উখরা আশমের ব্রজভূষণ শরণদেব এবং হলধর শরণদেব মোহান্ধ। সাবালকত্ব প্রাপ্তি র পর আশ্রমের দায়িত্বভার তিনি নিজ স্কন্ধে গ্রহন করেন। স্বচেষ্টায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত। তিনি যেমন ছিলেন সংস্কতজ্ঞ পণ্ডিত, তেমনি ছিলেন নিষ্কাম, উদার মনের, সাধু প্রকৃতির ব্যক্তি।
তিনি কিন্তু " তালুকদার মোহান্ত " ছিলেন। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তার ভীষণ আগ্রহ ছিল। " রাজরাজেশ্বর অপেরা"
নামে এক যাত্রা দল গঠন করেন। তাঁর সময়ে শ্রী রাধাবল্লভ
তপস্বী নামে এক সংস্কৃত পণ্ডিত দীর্ঘকাল আশ্রমে বসবাস করে গীতগোবিন্দম পাঠ , ভাগবত, এবং অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ
পাঠ, এবং ব্যাখ্যা করতেন।
সংক্রান্তির দিন ভোরে শোভাযাত্রা করে তিনি অজয়ে স্নানের ঘাটে যেতেন। পিছনে যেত নাম গানের দল।
তিনি স্নান করার পর স্নানযাত্রায় আগত ভক্তগন স্নান করতেন।
ফুলচাঁদ ব্রজবাসী ঃ পূর্ববর্তী মোহান্ধ হীরালাল ব্রজবাসী র প্রধান চেলা বা শিষ্য ছিলেন এই ফুলচাঁদ ব্রজবাসী । ১২৬০ বঙ্গাব্দে তিনি গদিয়ান হন।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত কর্মদক্ষ ব্যক্তি। তাঁর আমলে মোহান্ত অস্থলের প্রভূত উন্নতি হয়। সেনপাহাড়ী এবং সেনভূম পরগনার বহু পত্তনি এবং দরপত্তনির তালুক বা তালিকের অংশ তিনি ক্রয় করেন। কেন্দুলীর তালুকদার ছিলেন জনুবাজার গ্রামের দত্ত বাড়ি। পরবর্তী সময়ে তিনি কেন্দুলী র তালুক সহ নীলামে পত্তনি তালুক জনুবাজার ও খরিদ করে নেন। একজন নিষ্ঠাবান এবং দরদী মোহান্ত ছিলেন এই ভরতচন্দ্র। তাঁর সময়কাল কেন্দুলীর মোহান্ত অস্থল এর
এক গৌরব ময় সময়।
ফুলচাঁদ ব্রজবাসী নিজে আশ্রম মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন।
মন্দিরের পূজারী ছিলেন যোগেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
আশ্রমে সারা বৎসর পালিত হত নানা ব্রত, উৎসব।
এই সকল ব্রত উৎসবে পুরোহিতের কাজ করতেন লক্ষ্মীনারায়ণ গোস্বামী। শ্রী রামপুর পটির বিখ্যাত পণ্ডিত ঈশ্বর সিদ্ধান্ত আচার্য্য র সাথে ছিল তার গভীর সখ্য।
প্রায় প্রতিদিন ই তাঁদের দেখা সাক্ষাৎ, আলাপ আলোচনা হত।
এই ব্রজবাসী ফুলচাঁদের সময়েই নির্মিত হয় জয়দেব কেন্দুলী র বিখ্যাত পিতলের রথ।
নবরত্ন রাধাবিনোদ মন্দিরের অনুকরণে নির্মিত হয় বৃহদাকার
পিতলের রথ টি। ১২৯৬ থেকে ১২৯৮ পর্যন্ত এর নির্মানকাজ চলে। এই রথের প্রধান নির্মাতা ছিলেন কেন্দুলীর পশ্চিমে
টিকরবেতা গ্রামের শ্রী বনমালী মণ্ডল।
অন্যান্য যাঁরা এই নির্মান কার্যে যুক্ত ছিলেন তাঁরা হলেন
টিকরবেতা গ্রামের - ক্ষুদিরাম কর্মকার, ঈশ্বরচন্দ্র কর্মকার, প্রতাপচন্দ্র কর্মকার, বঙ্কুবিহারী কর্মকার, কাঙাল দাস বৈরাগ্য
এবং নবীন হাঁড়ি ।
দুবরাজপুরের - গণেশ কবিরাজ, রামেশ্বর দাসবৈরাগ্য, ঈশ্বর দাস বৈরাগ্য, পশুপতি দাস বৈরাগ্য।
ভিরিঙ্গি গ্রামের - গণেশ কর্মকার
প্রতাপপুরের - ননীতালাল কর্মকার
কাঁটাবেড়ে গ্রামের - নিকুঞ্জ কর্মকার
" হিসাবের খাতায় দেখা যায় ১২৯৬-৯৭ বঙ্গাব্দে রথ নির্মানের শিল্পী দের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছে প্রায় ১৫০০ / টাকা।
সহজেই অনুমান করা যায় কি বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়িত হয়েছিল সেই বৃহদাকার রথ নির্মানে।
রথ নির্মানের পর এই ফুলচাঁদ ব্রজবাসীর সময় থেকেই কেন্দুলী বিখ্যাত রথযাত্রা উৎসব এর শুরু হয়।
তাছাড়াও রাসউৎসব, দোলউৎসব, এর ও আয়োজন হত।
রামায়ন গান, ভাগবত পাঠ, কৃষ্ণযাত্রা ও অনুষ্ঠিত হত আশ্রমে।
এখানে উল্লেখ্য বিখ্যাত সাধক কবি নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায় তাঁর কৃষ্ণযাত্রার দল নিয়ে পালা গান পরিবেশন করতেন।
সেই আসরে রামপুরের ঈশ্বর সিদ্ধান্ত আচার্য্য মহাশয়ের উপস্থিতি ছিল একান্ত কাম্য। তাঁর সাথে সাধক নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায়ের বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। তিনি আসরে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত কণ্ঠ মশাই গানই শুরু করতেন না।
পিতলের রথের কারুকার্য --- অসামান্য এর গঠন। নির্মান শৈলী। রূপদক্ষ শিল্পী দের হাতে ফুটে উঠেছে অসামান্য সব
সারল্য ভরা চিত্র। হয়তো ড্রইং - এ সেই দক্ষতা নেই। কিন্তু
শিল্পীরা খোদাই করেছেন মনের আনন্দে। কিন্তু নারীমুখে এসেছে বিষাদ। আছে নগ্নিকারা। প্রশ্ন জাগে এত নগ্নতা কেন!
সেখানে কি গীতগোবিন্দের বিকৃত প্রভাব! না কি সমাজ চিত্রণ!
ফুলচাঁদ ব্রজবাসী র সময় থেকেই কেন্দুলী তে রথযাত্রা উৎসব
শুরু হয়। উৎসাহ উদ্দীপনায় রথ কেন্দুলী র পথ পরিক্রমা করে।
দীর্ঘ দিন এই উৎসব চালু থাকার পর নানাবিধ কারনে রথযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। রথ টি ভেঙে ছোট করার প্রয়োজনে রথ টি কে ভাঙা শুরু হতেই জনমানসে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ভীষণ গোলযোগ সৃষ্টি হয়।
যাক শেষ পর্যন্ত রথটিকে আবার মোটামুটি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। তবে অলংকৃত অনেক প্লেট হারিয়ে বা চুরি হয়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত গতবৎসর ; প্রায় পঞ্চাশ বছর পর আবার সেই রথ
বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে জয়দেব কেন্দুলী র পথে নামে। এই রথযাত্রা উপলক্ষ্যে বিশাল জনসমাবেশ ঘটেছিল।
মোহান্ত অস্থল ; তাঁদের সহযোগীগন ; জয়দেব কেন্দুলী সেবা ও সংস্কৃতি সমিতি ; সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ' ভক্তি ভবন ' এর
সদস্য গনের সক্রিয় সহযোগিতায় ঐতিহ্য মণ্ডিত রথযাত্রা উৎসব জয়দেব কেন্দুলী তে পুনরায় চালু হয়।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------
এই প্রবন্ধে পূর্বাপর সকল ব্রজবাসী মোহান্ত র নাম বা তাঁদের কার্যকাল সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়নি।
সংক্ষেপে - রাধারমণ ব্রজবাসী কেই প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে গন্য করা হয়। বর্ধমানের রাজা ত্রিলোকচন্দ্রের আমলেই কেন্দুলী র নিম্বার্ক আশ্রমের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল দ্বাদশ বঙ্গাব্দের
ষষ্ঠ অথবা সপ্তম শতকে।
যদিও বর্ধমান রাজবাড়ির দেওয়ানের দপ্তর থেকে এক পত্র মারফত বৃন্দাবন থেকে আগত রাধামোহন ব্রজবাসী নামক
এক সাধু প্রকৃতি র ব্যক্তি কে বেশ কিছু জমি জায়গা, এবং নগদ ৩৬১ / টাকা প্রদান করা হয়। ১১৬২ বঙ্গাব্দে ২১ শে মাঘ। তিনি কেন্দুবিল্বে বসবাস করে সেনপাহাড়ী এবং সেনভূম, শেরগড়, সিলামপুর প্রভৃতি স্থানে
সদাসেবাব্রত পালনের ব্যবস্থা করতেন।
মনে হতে পারে তিনিই হয়তো কেন্দুলীর মোহান্ত অস্থল এর প্রতিষ্ঠাতা। বিশিষ্ট ওড়িয়া গবেষক বনমালী রথ তাঁকেই
গদির প্রতিষ্ঠাতা বলে উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু তাঁর নামের আগে ' সেবাইত ' গোস্বামী, বা মোহান্ত
কোন কথারই উল্লেখ নাই।
ব্রজবাসী রাধামোহন কেন্দুলীর নিম্বার্ক আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা না হলেও এখানে আশ্রম স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে
তিনি তার ক্ষেত্র রচনা করেছিলেন নিঃসন্দেহে। "
রাজা ত্রিলোক চন্দ্রের সময়ে দ্বিতীয় একটি পত্রে দেখা যাচ্ছে
রাধারমণ ব্রজবাসী কে সেবাইত বলা হচ্ছে। তিনি যে আখড়া ধারী তাও বলা হচ্ছে। সেই জন্য রাধারমণ কেই প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়।
সমাধি ক্ষেত্রে রাধারমণ ব্রজবাসী থেকে সর্বেশ্বর ব্রজবাসী পর্যন্ত সাতজন গোস্বামী র সমাধি রয়েছে। অন্য কারোর নয়।
হয়তো তাঁরা এখানে দেহত্যাগ করেন নি। বা বৈষ্ণবীয় ধারায়
প্রতিষ্ঠাতা হলে বা আখড়া ধারী সেবাইত হলে তাঁরই সমাধি
সমাধিস্থলে থাকে। এমনকি রাধারমন ব্রজবাসীর গুরু
ভরদ্বাজ মহান্তের ও সমাধি এখানে নাই।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------
ব্রজবাসী আশ্রম ধারী পূর্বসুরীসাত গোস্বামী র নাম যাঁদের
সমাধি রয়েছে, সমাধি ক্ষেত্রে ------------
১) রাধারমণ ব্রজবাসী ২) ভরতচন্দ্র ৩) প্যারীচরণ ৪) হীরালাল ৫) ফুলচাঁদ ৬)রামগোপাল ৭) সর্বেশ্বর
( সকলেই ব্রজবাসী)
সর্বেশ্বর এর পর মোহান্ত হয়েছিলেন দামোদর চন্দ্র ব্রজবাসী।
তারপর রাসবিহারী ব্রজবাসী। হরিকান্ত শরণদেব কে স্বেচ্ছায়
মোহান্ত পদ ছেড়ে দেন রাসবিহারী ব্রজবাসী।
" পত্তনি তালুক দার মোহান্ত ' বলে কেন্দুলী র মোহান্ত গণ
নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন বিভিন্ন কাগজপত্রে। অর্থাৎ তাঁরা
একাধারে ছিলেন ধর্মজগতের মানুষ, আবার অন্যদিকে ছিলেন বিষয় জগতের মানুষ। বিষয় বাসনা কে পরিহার করেই
প্রবেশ করতে হয় ধর্মজগতে। তাই ধর্ম ও বিষয় পরস্পর বিরুদ্ধ এই দু ' য়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা সুকঠিন। কেন্দুলী র কোন কোন মহান্তের পক্ষে সেই সামঞ্জস্য বিধান করা সম্ভব হয়নি। আশ্রম পরিচালনার জন্য আয়ের উৎস স্বরূপ কিছু কিছু দেবোত্তর জমি জায়গা হয়তো থাকা দরকার-কিন্তু অগাধ ধনসম্পদের কোন প্রয়োজন হতে পারেনা।জানা যায় দেবতার নামে বিষয় সম্পত্তি উত্তোরত্তর
বাড়িয়ে চলা যেন নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল দু - এক জন মহান্তের
তাই স্বাভাবিক বিষয় বিষে বিষিয়ে গিয়েছিল তাঁদের পবিত্র
সাধক জীবন - তাঁদের আমলে অবাঞ্ছনীয় হীণ কার্যকলাপে
কলুষিত হয়েছিল পবিত্র আশ্রম। "
বর্তমানে আশ্রমের আয় খুবই সীমিত। জমি জায়গা সব বেদখল হয়ে গেছে। উৎপন্ন শস্যের ভাগ চাষি দের কাছ থেকে আশ্রমে আসেনা।
তারই মধ্যে আশ্রম পরিচালনা করতে হয়। কেন্দুলীর নিম্বার্ক আশ্রম কে রাজরাজেশ্বর মঠও বলা হয়। কারণ শ্রী শ্রী রাজরাজেশ্বর ই এই আশ্রমের মূল দেবতা। তিনি শালগ্রাম শিলায় পূজিত হন। রাধারমণ ব্রজবাসী ই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন
এই শালগ্রাম শিলা। পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন নানা
দেবদেবী। চৈতন্য মহাপ্রভু ও গৃহীত হয়েছেন সমাদরে।
কেন্দুলীর মোহান্ত আশ্রম নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের হলেও এখানে পূজিত নানা দেবদেবীর অধিষ্ঠান দেখে বোঝা যায় --- রামাইত, মধ্বাচার্য, বল্লভী, গৌড়ীয় ইত্যাদি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বৈষ্ণব ধর্মের মিলনক্ষেত্র কেন্দুলীর এই মোহান্ত আশ্রম।
পৌষসংক্রান্তির অজয়ে স্নানের জমায়েত কে নদী গর্ভ থেকে তুলে এনে ডাঙা য় বা মোহান্ত আশ্রমের সামনের রাস্তার দুপাশে
মেলা বসিয়েছিলেন এঁরাই। মেলার সময় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বৈষ্ণব রা দেশের নানা স্থান থেকে এসে এখানে আশ্রয় নিতেন।
বর্তমানে সেই সমাবেশ না হলেও আশ্রম পরিচালনা করার
আন্তরিক প্রয়াস রয়েছে বর্তমান ব্রজবাসী সহ সহযোগী আশ্রম পরিচালক দের।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ সমাপ্ত।
গ্রন্থ ঋণ। জয়দেব কেন্দুলী র মোহান্ত আশ্রম। ড′• অজিত কুমার দাস।
জেলা গেজেটিয়ার। বীরভূম। ও ' ম্যালি
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা লাইন।
গীতগোবিন্দম । সাহিত্য রত্ন হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়
নেট মাধ্যম। উইকিপিডিয়া।
চিত্র ঋণ। পুরাতন রথের ছবি ( সাদা কালো ছবি)
মুকুল দে আর্কাইভ থেকে। সত্যশ্রী উকিল এর সৌজন্যে প্রাপ্ত।
শিবের বিবাহ সহ কয়েকটি প্লেটের ছবি।
------------- ------------ ------------ ------------ ------------
** লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সরকারি উদ্যোগের
" বাউল তীর্থ পত্রিকা য় "। আজ ছিল মেলার উদ্বোধনী দিন।আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। সেখানেই পত্রিকা প্রকাশিত হল।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------
মোহান্ত অস্থল এর প্রাচীণ রথের ছবি।
মূল ছবি। মুকুল দে আর্কাইভ থেকে। সত্যশ্রী উকিল দা র সৌজন্যে প্রাপ্ত।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------