।। উখরা।। উখরার জমিদার হাণ্ডা পরিবারের বিখ্যাত রথ।।
গিয়েছিলাম উখরা। সে তো কতবার ই এর উপর দিয়ে গেছি।
যাতায়াত করেছি। কিন্তু কখনও উখরার জমিদার হাণ্ডা বাবুদের প্রাসাদ ; ঠাকুর বাড়ি ; এবং বিখ্যাত পিতলের রথ টি দেখা হয়নি।
সে কোন ছোট বেলায় আমার মেজো মেসোমশাই এর সাথে
এখনকার বিখ্যাত রথের মেলা বা ঝুলন মেলা দেখেছি। সে
বহুদূর সুখস্মৃতি।
এবার আমার লক্ষ্য ছিল এখানকার জমিদার বাড়ির বিখ্যাত
কারুকার্য মণ্ডিত পিতলের রথ টি কে ভালো করে দেখার।
এই বিখ্যাত নয়চূড়ার রথটির প্রধান নির্মাতা ছিলেন আমাদের
প্রতিবেশী এলাকা আদুরিয়া অমরপুর এর অমরপুর গ্রামের
বিখ্যাত কারিগর রাধাবল্লভ মেহতরী। সাথে ছিলেন এখানকারই অপর একজন কারিগর। এছাড়া অন্যান্য কারিগর রা তো ছিলেন ই। অসাধারণ এই পিতলের রথ। অসামান্য অলংকরণ। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবেনা। কি অসাধারণ শিল্প দক্ষতা র নিদর্শন এই রথ।
প্রাচীন এবং আধুনিক শিল্পের উভয় ধারার সাথে শিল্পী দের উত্তম ধারণা ছিল। কাঠের রথ নষ্ট হয়ে যাবার পর এই রথ
নির্মিত হয় শৈলবিহারী লাল হাণ্ডের আনুকুল্যে।
কথা বলে গিয়েছিলাম জমিদার বাড়ির উত্তর পুরুষ শ্রী অনুরণ লাল সিং হাণ্ডা র সাথে।
অসাধারণ সৌজন্য। নিজে সাথে করে সব ঘুরিয়ে দেখালেন।
প্রাচীন অন্দরমহল বা বাহিরমহল এর সংস্কার কার্য্য কি ভাবে হচ্ছে দেখালেন। কত প্রাচীন সামগ্রী। তিনি ঐকান্তিক চেষ্টা করছেন ঐ বিশাল স্থাপত্যের সংস্কার সাধনের।
তাঁদের অফিসের ঠান্ডা কক্ষে বসালেন। তাঁর বাবা মাননীয় শোভনলাল বাবু এবং কাকা র সাথে অনেক গল্প হল।
দুপুরে গোপীনাথ জীউ এর ভোগ প্রসাদ গ্রহণ করলাম।
এক চমৎকার অভিজ্ঞতা। রথের মেলায় যাবার আমন্ত্রণ জানালেন। বিশিষ্ট মানুষ দের তাঁরা আমন্ত্রণ পত্র পাঠান।
রথ যাত্রা ; ঝুলন মেলা ; দুর্গোৎসব ; গোষ্ঠ উৎসব ; সরস্বতী পূজা সারা বৎসর ধরেই নানা অনুষ্ঠান।
নিশ্চয়ই যাব। শীতে। কাজ আছে।
সংক্ষেপে উখরার কথা কিছু বলি।
প্রাচীন গঞ্জ। সার্ভেয়ার জেনারেল রেণেল সাহেবের ম্যাপে (১৭৭৯ সালের) এর নাম ' ওখেরালি '।
Okherali। উত্তর দক্ষিণ এবং পূর্ব পশ্চিম দুই রাস্তার সংযোগ স্থলে এর অবস্থিতির জন্য গঞ্জ হিসাবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। আজকের অণ্ডাল তখন ভবিষ্যতে র গর্ভে। আর এখন কয়লাখনি এলাকার অন্যতম
গঞ্জ শহর। রেল এবং বাস যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে।
জমিদার হাণ্ডা পরিবারের কথা ঃ এঁদের পূর্বপুরুষ ব্যবসায়ী
কেবল রাম হাণ্ডা ১৬৩২ সালে লাহোর থেকে বাঙ্গলায় আসেন। সেই সময় মুর্শিদাবাদের সমৃদ্ধি র জন্য সেখানেই
বসতি স্থাপন করেন। দক্ষ ব্যবসায়ী। দ্রুত উন্নতি করেন।
তাঁর ছেলে রামচন্দ্র হাণ্ডার সাথে বর্ধমান রাজ পরিবারে র সাথে সংযুক্ত ঘনশ্যাম কাপুরের মেয়ের বিয়ে হয়। তাঁর পুত্র
মেরুচাঁদ ( মেহের চাঁদ) কর্মদক্ষতা র জন্য নবাব আলীবর্দি র
দেওয়ান হয়েছিলেন। কিন্তু নানা অবাঞ্চিত ঘটনার আশংকায়
মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে এই উখরায় ( তখন নাম শেরগড়) এসে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর পুত্র বক্তার সিং এবং কন্যা বিষণ কুমারী। এই বিষণকুমারী র সাথে বর্ধমানের রাজা ত্রিলোক চাঁদ এর বিয়ে হয়। এবং এই হাণ্ডা পরিবার শেরগড় পরগণা য়
এই উখরার বিরাট জমিদারি প্রাপ্ত হন। এই বংশের পুলিন বিহারী হাণ্ডা রায় বাহাদুর খেতাব লাভ করেন।
১৭৩৯ সালে মেরুচন্দ্র বিশাল রাম-সীতার মন্দির এবং দামোদর জীউ এর দালান মন্দির তৈরী করান। পরে বক্তার সিং মন্দিরের সংস্কার সাধনের পর দাঁইহাট থেকে গোপীনাথ জীউ এর যুগল মূর্তি এনে এখানে স্থাপন করেন।
শম্ভুনাথ সিং এখানকার বিখ্যাত দুর্গাপূজা চালু করেন।
১২ পুরুষ যাবৎ তাঁরা এখানে বাস করছেন। নানাবিধ ব্যবসা বাণিজ্য এবং পরবর্তী সময়ে কয়লার ব্যবসায় তাঁরা প্রভূত
ধনার্জন করেন। উখরার জমিদারি প্রাপ্তি র পর তাঁরা
' লাল সিং হাণ্ডা ; পদবী ব্যবহার করেন।
উখরার প্রাচীনতম মন্দির টি ঘনশ্যাম দাস প্রতিষ্ঠিত শ্যামরায়ের মন্দির। ১৬০৮ শকাব্দে নির্মিত। অর্থাৎ ১৬৮৬ সালে।
এখানের প্রস্তর নির্মিত দ্বারবাসিনী দেবীর মন্দির সহ অনেক
ধর্মরাজ মন্দির ; শিবমন্দির রয়েছে। এগুলিও যথেষ্ট প্রাচীন।
উখরার মোহান্ত অস্থল ও খুব বিখ্যাত। বর্ধমানের রাজা কীর্তি চাঁদ এখানে ২৫১ বিঘা জমি দান করেন।
এখানের বিশাল দিঘি " শুকা সায়ের " ও খুব বিখ্যাত। এখানের জলেই একদিন উখরার তৃষ্ণা নিবারিত হয়েছে।
' উখরা হল প্রাচীন ; বর্ধিষ্ণু ; এবং বড় গ্রাম। কয়লা খণি অঞ্চলের আজ এক বিশিষ্ট গঞ্জ। প্রায় মিউনিসিপ্যাল শহরের
আকার নিচ্ছে এখানের আর এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম খাঁদরা র সাথে
সংযুক্ত হয়ে।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------ সমাপ্ত © প্রণব ভট্টাচার্য।
আগামীকাল রথযাত্রা র প্রাক্কালে এই লেখা।