Wednesday, 29 June 2022

উখরা।। উখরার জমিদার হাণ্ডা পরিবারের বিখ্যাত পিতলের রথ

।। উখরা।। উখরার জমিদার হাণ্ডা পরিবারের বিখ্যাত রথ।। 

 গিয়েছিলাম উখরা। সে তো কতবার ই এর উপর দিয়ে গেছি। 
 যাতায়াত করেছি। কিন্তু কখনও উখরার জমিদার হাণ্ডা বাবুদের প্রাসাদ ; ঠাকুর বাড়ি ; এবং বিখ্যাত পিতলের রথ টি দেখা হয়নি। 
সে কোন ছোট বেলায় আমার মেজো মেসোমশাই এর সাথে 
 এখনকার বিখ্যাত রথের মেলা বা ঝুলন মেলা দেখেছি। সে 
 বহুদূর সুখস্মৃতি। 
 এবার আমার লক্ষ্য ছিল এখানকার জমিদার বাড়ির বিখ্যাত 
 কারুকার্য মণ্ডিত পিতলের রথ টি কে ভালো করে দেখার। 
 এই বিখ্যাত নয়চূড়ার রথটির প্রধান নির্মাতা ছিলেন আমাদের 
প্রতিবেশী এলাকা আদুরিয়া অমরপুর এর অমরপুর গ্রামের 
 বিখ্যাত কারিগর রাধাবল্লভ মেহতরী। সাথে ছিলেন এখানকারই অপর একজন কারিগর। এছাড়া অন্যান্য কারিগর রা তো ছিলেন ই। অসাধারণ এই পিতলের রথ। অসামান্য অলংকরণ। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবেনা। কি অসাধারণ শিল্প দক্ষতা র নিদর্শন এই রথ। 
 প্রাচীন এবং আধুনিক শিল্পের উভয় ধারার সাথে শিল্পী দের উত্তম ধারণা ছিল। কাঠের রথ নষ্ট হয়ে যাবার পর এই রথ 
 নির্মিত হয় শৈলবিহারী লাল হাণ্ডের আনুকুল্যে। 
 কথা বলে গিয়েছিলাম জমিদার বাড়ির উত্তর পুরুষ শ্রী অনুরণ লাল সিং হাণ্ডা র সাথে। 
 অসাধারণ সৌজন্য। নিজে সাথে করে সব ঘুরিয়ে দেখালেন। 
 প্রাচীন অন্দরমহল বা বাহিরমহল এর সংস্কার কার্য্য কি ভাবে হচ্ছে দেখালেন। কত প্রাচীন সামগ্রী। তিনি ঐকান্তিক চেষ্টা করছেন ঐ বিশাল স্থাপত্যের সংস্কার সাধনের। 
 তাঁদের অফিসের ঠান্ডা কক্ষে বসালেন। তাঁর বাবা মাননীয় শোভনলাল বাবু  এবং কাকা র সাথে অনেক গল্প হল। 
 দুপুরে গোপীনাথ জীউ এর ভোগ প্রসাদ গ্রহণ করলাম। 
 এক চমৎকার অভিজ্ঞতা। রথের মেলায় যাবার আমন্ত্রণ জানালেন। বিশিষ্ট মানুষ দের তাঁরা আমন্ত্রণ পত্র পাঠান। 
 রথ যাত্রা ; ঝুলন মেলা ; দুর্গোৎসব ; গোষ্ঠ উৎসব ; সরস্বতী পূজা  সারা বৎসর ধরেই নানা অনুষ্ঠান। 
 নিশ্চয়ই যাব। শীতে। কাজ আছে। 
 সংক্ষেপে উখরার কথা কিছু বলি। 
 প্রাচীন গঞ্জ। সার্ভেয়ার জেনারেল রেণেল সাহেবের ম্যাপে (১৭৭৯ সালের) এর নাম ' ওখেরালি '। 
 Okherali। উত্তর দক্ষিণ এবং পূর্ব পশ্চিম দুই রাস্তার সংযোগ স্থলে এর অবস্থিতির জন্য গঞ্জ হিসাবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। আজকের অণ্ডাল তখন ভবিষ্যতে র গর্ভে।  আর এখন কয়লাখনি এলাকার অন্যতম 
 গঞ্জ শহর। রেল এবং বাস যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। 
 জমিদার হাণ্ডা পরিবারের কথা ঃ  এঁদের পূর্বপুরুষ ব্যবসায়ী 
 কেবল রাম হাণ্ডা ১৬৩২ সালে লাহোর থেকে বাঙ্গলায় আসেন। সেই সময় মুর্শিদাবাদের সমৃদ্ধি র জন্য সেখানেই 
 বসতি স্থাপন করেন। দক্ষ ব্যবসায়ী। দ্রুত উন্নতি করেন। 
 তাঁর ছেলে রামচন্দ্র হাণ্ডার সাথে বর্ধমান রাজ পরিবারে র সাথে সংযুক্ত ঘনশ্যাম কাপুরের মেয়ের বিয়ে হয়। তাঁর পুত্র 
 মেরুচাঁদ ( মেহের চাঁদ)  কর্মদক্ষতা র জন্য নবাব আলীবর্দি র 
 দেওয়ান হয়েছিলেন। কিন্তু নানা অবাঞ্চিত ঘটনার আশংকায় 
 মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে এই উখরায় ( তখন নাম শেরগড়) এসে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর পুত্র বক্তার সিং এবং কন্যা বিষণ কুমারী। এই বিষণকুমারী র সাথে বর্ধমানের রাজা ত্রিলোক চাঁদ এর বিয়ে হয়। এবং এই হাণ্ডা পরিবার শেরগড় পরগণা য়
 এই উখরার বিরাট  জমিদারি প্রাপ্ত হন। এই বংশের পুলিন বিহারী হাণ্ডা রায় বাহাদুর খেতাব লাভ করেন। 
 ১৭৩৯ সালে মেরুচন্দ্র বিশাল রাম-সীতার মন্দির এবং দামোদর জীউ এর দালান মন্দির তৈরী করান। পরে বক্তার সিং মন্দিরের সংস্কার সাধনের পর দাঁইহাট থেকে গোপীনাথ জীউ এর যুগল মূর্তি এনে এখানে স্থাপন করেন। 
 শম্ভুনাথ সিং এখানকার বিখ্যাত দুর্গাপূজা চালু করেন। 
  ১২ পুরুষ যাবৎ তাঁরা এখানে বাস করছেন। নানাবিধ ব্যবসা বাণিজ্য  এবং পরবর্তী সময়ে কয়লার ব্যবসায় তাঁরা প্রভূত 
 ধনার্জন করেন। উখরার জমিদারি প্রাপ্তি র পর তাঁরা 
  ' লাল সিং হাণ্ডা ; পদবী ব্যবহার করেন। 

উখরার প্রাচীনতম মন্দির টি ঘনশ্যাম দাস প্রতিষ্ঠিত শ্যামরায়ের মন্দির। ১৬০৮ শকাব্দে নির্মিত। অর্থাৎ ১৬৮৬ সালে। 
 এখানের প্রস্তর নির্মিত দ্বারবাসিনী দেবীর মন্দির সহ অনেক 
 ধর্মরাজ মন্দির ; শিবমন্দির রয়েছে। এগুলিও যথেষ্ট প্রাচীন। 
 উখরার মোহান্ত অস্থল ও খুব বিখ্যাত। বর্ধমানের রাজা কীর্তি চাঁদ  এখানে ২৫১ বিঘা জমি দান করেন। 
 এখানের বিশাল দিঘি " শুকা সায়ের " ও খুব বিখ্যাত। এখানের জলেই একদিন উখরার তৃষ্ণা নিবারিত  হয়েছে। 
  ' উখরা হল প্রাচীন ; বর্ধিষ্ণু ; এবং বড় গ্রাম। কয়লা খণি অঞ্চলের  আজ এক বিশিষ্ট গঞ্জ। প্রায় মিউনিসিপ্যাল শহরের 
 আকার নিচ্ছে এখানের আর এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম খাঁদরা র সাথে 
 সংযুক্ত হয়ে। 
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------ সমাপ্ত © প্রণব ভট্টাচার্য। 
 আগামীকাল রথযাত্রা র প্রাক্কালে এই লেখা। 
 
 

 

 


ইলামবাজার। প্রাচীন এক গঞ্জের ইতিকথা

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=pfbid027wr4E4LUCbz14AQQTGJg78qNrjXhSfUfWPJrDzWEh1X838KY4Djp13oy9VqNQgizl&id=100003636821328
ইলামবাজার প্রাচীন এক গঞ্জের ইতিকথা। 

Saturday, 18 June 2022

১লা আষাঢ়। ভক্তি ভবন। গীতগোবিন্দ দিবস উদযাপন।

।। ১ লা আষাঢ়। ভক্তি ভবন। জয়দেব কেন্দুলী।। 
  " গীতগোবিন্দ দিবস " 
 ১ লা আষাঢ়। 
 " আষাঢ়স্য প্রথম দিবস " 
 " মেঘৈর্ম্মেদুরম্বরং বনভুবঃ শ্যামাস্তমালদ্রুমৈ - "
  মেঘে মেঘে ছাইল আকাশ। 
 এই তো সেই কাল  যখন কবিমন থেকে উৎসারিত হয়  কাব্যরস ধারা। 
 এমনই দিনে প্রত্যেক বৎসর জয়দেব কেন্দুলী র  সাংস্কৃতিক 
 ভবন " ভক্তি ভবনে " উদযাপিত হয় " গীতগোবিন্দ " দিবস। 
 জয়দেব  অঞ্চল সংস্কৃতি সেবা  সমিতির আন্তরিক উদ্যোগে। বিশিষ্ট গুণীজনদের আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয় 
 সভাপতি এবং প্রধান অতিথি হিসাবে। 
 এবার এসেছিলেন মাননীয় দুই অধ্যাপক শ্রী তপন গোস্বামী 
 মহাশয় এবং শ্রী অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়। 
   মাননীয় শ্রী শান্তি রজক মহাশয়ের গীতগোবিন্দম থেকে গান দিয়ে শুরু। তারপর কৃতী দুই ছাত্রের সংবর্ধনা। 
 ব্যক্তিগত ভাবে তাদের পুরস্কৃত করলেন মাননীয় শিক্ষক 
 শ্রী দেবকুমার দত্ত মহাশয়। 
 আমন্ত্রিত কবিদের কবিতাপাঠ। 
 বীরভূম  জেলার চার বিশিষ্ট কবিকে সংবর্ধনা। মানপত্র প্রদান। সংবর্ধিত চার কবি সর্বশ্রী প্রভাত সাহা ; নীলোৎপল ভট্টাচার্য ; ফাল্গুনী ভট্টাচার্য ; এবং আব্দুল বাসার খান। 
  টিকরবেতার ঐতিহ্যমণ্ডিত কাঁসা পিতল শিল্পকে মাথায় রেখে 
 এঁদের মানপত্র  কাঁসার থালায় খোদাই করা। চমৎকার। 
 
প্রধান অতিথি র ভাষণে পুঁথি সংগ্রাহক ; বিশেষজ্ঞ ; বাঁকুড়া 
 বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক শ্রী অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের  গীতগোবিন্দ এর পুঁথি তথা সামগ্রিক আলোচনা আমাদের সমৃদ্ধ করে। তিনি ভক্তি ভবনে সংরক্ষণের জন্য একটি প্রাচীন গীতগোবিন্দ এর পুঁথি দান করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। 
 স্বল্প কথায় কবি অধ্যাপক শ্রী তপন গোস্বামী র বক্তব্য অত্যন্ত 
 মনোমুগ্ধকর। 
  এই এলাকা তথা অজয়ের এপার ওপার নিয়ে যে এলাকা 
  তার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল কে রক্ষা তথা বিকশিত করার কাজে ভক্তি ভবনে র এই দীর্ঘ দিনের নিরলস  উদ্যোগ 
 খুবই প্রশংসনীয়। জয়দেব  অঞ্চল  সংস্কৃতি সেবা  সমিতি এবং তাঁদের সাহায্য সহযোগিতা কারী সকলেই ধন্যবাদার্হ। 
 ভক্তি ভবন  হয়ে উঠেছে আমাদের সকলের মিলনক্ষেত্র। 
 কত গুণী জনের সান্নিধ্য এখানে মেলে। দেখা সাক্ষাৎ ; গল্প ;
 আড্ডা ; দুপুরের চমৎকার খাওয়া দাওয়া ; বিকেল শেষের 
 ঘরোয়া গল্প সব মিলিয়ে এক 'মুক্ত বাতাসে র শ্বাস। 
 ১৪০৩ সালের ১লা আষাঢ় শুরু হয়েছিল এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। গেষ্ট হাউসের হলঘরে হয়েছিল সে অনুষ্ঠান। সেদিন সেখানেও ছিলাম। একে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তরুণ প্রজন্মকে সাথে চাই। তারা কই। তাদের কে তো আগিয়ে  আনতে হবে। 
 আমার মনে হয়। এলাকায় আরও অনেকে আছেন 
 যাঁদের কে সমিতির সাথে যুক্ত করা যায়। সে প্রচেষ্টা নিতে হবে। সংস্কৃতি মনস্ক সকলকে যদি একত্রিত করা যায়। রণজিৎ দা ; আনারুল ভাই ; উত্তম দা ; শান্তি দা  সহ 
 সকলে ভেবে দেখবেন। 
 ভীষণ রকমের এক শূণ্যতা তৈরী হতে যাচ্ছে নিকট ভবিষ্যতে। 
 " ভক্তি ভবনে র " এই সাধু উদ্যোগ কে যে বাঁচিয়ে রাখতে হবেই। দায়িত্ব আমাদের সকলের। 
 ------------ ------------ ------------ ------------ ------------ 
 বামপন্থী নেতা ; বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী ভক্তি ভূষণ মণ্ডলের 
 নামে এই " ভক্তি ভবন "। 
 
  
 
 
  ------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------

Friday, 10 June 2022

কবিবর জয়দেব গোস্বামী। রাধাবিনোদ মন্দির


।। কবিবর জয়দেব গোস্বামী ঃ কেন্দুবিল্ল্ব এবং রাধাবিনোদ মন্দির।।  প্রণব ভট্টাচার্য
পশ্চিম হইতে পূর্বে প্রবাহিত প্রাচীণা ' অজাবতী "। অজয় এর প্রাচীন নাম। পূর্ব বাহিনী তাই পৌরাণিক মতে সে নদী। আবার
উপনদী গ্রহণ করে ভূগোল বিজ্ঞান অনুযায়ী সে নদ।
এই অজয়ের উত্তর পারে তাল ; তমাল ; বট ; অশ্বত্থ ; কেন্দু ;
শ্রীফলের ছায়া সুশীতল এক অতি ক্ষুদ্র পল্লী তে ; ব্রাহ্মন ভোজদেব মাতা বামাদেবীর কুটীরে ; পৌষের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে আনুমানিক ১১২৩  সাধারণ অব্দে জয়দেবের জন্ম।
সেখ শুভোদয়ার ' বিবরণ থেকে জানা যায় রাজা লক্ষ্মণ সেন
কবি জয়দেবের চেয়ে চার বৎসরের বড়ো ছিলেন। রাজা লক্ষ্মণ সেনের জন্মবর্ষ ১১১৯ সাধারণ অব্দ থেকে রাজা বল্লালসেন ' লক্ষণাব্দ ' চালু করেন। সেই হিসাবে জয়দেবের জন্মবর্ষ হয় ১১২৩ সা অব্দ।
জয়দেব ছিলেন রাজা লক্ষ্মণ সেনের প্রিয় বন্ধু ; এবং সভাসদ।
" গোবর্দ্ধনশ্চ শরণো জয়দেব উমাপতি ;
  কবিরাজশ্চ রত্নানি পঞ্চৈতে লক্ষণস্য চ্ "
কবিবর দেহরক্ষা করেছিলেন ১১৭৩ সম্বতে বা ১২২৮ সা অব্দে। সেই হিসাব অনুযায়ী ১০৫ বৎসর তাঁর জীবনকাল।
মৃত্যু তিথি বলা হয়েছে " শুক্লাষ্টমী পৌষী উত্তরায়ণ সংক্রমে "
কবি জয়দেব ছিলেন বৃন্দাবনের নিম্বার্ক আশ্রম শ্রী শ্রী টাট্টিস্থান আশ্রমের ৪৬ তম আচার্য।
কেন্দুবিল্ব ঃ  কেন্দুবিল্ব বা কেঁদুলী। কেন্দু আর বিল্ববৃক্ষ
আচ্ছাদিত সামান্য এক পল্লী। নদী ধারে বট পাকুরের মেলা।
পাশেই বিখ্যাত কদম্বখণ্ডী মহা শ্মশান।
জয়দেবের সময় কেন্দুবিল্ব পূর্ব দিকে মন্দিরা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মন্দির ময় মন্দিরা। ছিল একদিন। আজ সকলি ধ্বংস স্তুপ। মৌজার নাম কবির পুর। পাশেই বালারপুর গ্রাম।
গ্রামনামে রাজা বল্লালসেনের স্মৃতি।
কবি জয়দেবের পূজিত শ্রী শ্রী  রাধামাধবের মূল মন্দির কবেই
অজয়ের বন্যার আঘাতে ধ্বংস প্রাপ্ত। শোনা যায় সেই পাথরের মন্দির নির্মান করিয়েছিলেন রাজা লক্ষ্মণ সেন।
সে মন্দির ছিল সম্ভবত মন্দিরা তেই। দু টি প্রস্তর খণ্ড রক্ষিত
আছে পুরাতন সেই স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে।
এই মন্দিরা তেই বাস করতেন কবি জয়দেব তাঁর স্ত্রী তথা সাধন  সঙ্গিনী পদ্মাবতী র সাথে।
উভয়েই ছিলেন নৃত্য ; গীত ; বাদ্য ; সুর তাল লয় ছন্দের
অসামান্য গুণী মানুষ।


গীতগোবিন্দম্ ঃ " গীতগোবিন্দ রচয়িতা কবি জয়দেব সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি এবং সংস্কৃত ভাষায়
সর্বাপেক্ষা মধুর গীতি কবিতার কবি বলিয়া সর্ব্ববাদীসম্মত
ক্রমে সম্মানিত হইয়া আছেন। "  - ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।
" স্মরগরল খণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং -
    ' দেহী পদপল্লব মুদারম "
  ভক্ত জন পরম ভক্তি তে বিশ্বাস করেন " দেহী পদপল্লব মুদারম " এই পাদপূরণ স্বয়ং ভগবান ই জয়দেবের রূপ ধরে
করেছিলেন। তেমন কাহিনী ই সুপ্রচারিত।
অনেকে গীতগোবিন্দে আদিরসের সন্ধান করেন। কিন্তু ডক্টর
সেন যথার্থই বলেছেন " জয়দেবের কাব্যে শ্লীলতা র গণ্ডী সাবধানে রক্ষিত হইয়াছে "।" বস্তুতঃ ভারতীয় ভক্তিমার্গের দৃষ্টি তে গীতগোবিন্দ কে চরম আদিরসাত্মক কাব্য বলে গ্রহণ করা হয়নি " - বলেছেন ডক্টর সুধীর কুমার করণ।

আজও অনেকের বিশ্বাস পৌষ সংক্রান্তি র ভোরে মা গঙ্গা উজান বেয়ে কেন্দুবিল্বের ঘাট পর্যন্ত আসেন। তাঁর ভক্ত জয়দেবের মনোবাঞ্চা পূরণের জন্য। তাই পুণ্যস্নানের জন্য
লক্ষ নরনারীর ভীড় জমে।

কেন্দুলী র মেলা ঃ  এ এক প্রাচীন মেলা। কবে থেকে শুরু তা বলা কিছুতেই সম্ভব নয়। গ্রামীণ স্নানের মেলা। অনাড়ম্বর ভাবেই একদিন শুরু হয়েছে।
গোপাল হালদার মশাই বলেছেন " কেন্দুলী তে জয়দেবের মেলা পৃথিবীর প্রাচীণতম মেলা - জনতার কবিপূজা জয়ন্তী উৎসব "
মকর সংক্রান্তি তে কেন্দুলীর মেলায় মোহান্ত দের ৪৬ তম কুলগুরু জয়দেবের তিরোধান দিবস হিসাবে পালন করে আসছেন নিম্বার্ক আশ্রমের মোহান্ত গন আশ্রমের প্রতিষ্ঠা কাল
থেকেই। নদী চর থেকে এই মেলাকে ভূখণ্ডে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন এই মোহান্ত রাই।
জয়দেব কেন্দুলী র নিম্বার্ক আশ্রম ঃ " শ্রী ধাম বৃন্দাবন হইতে আগত স্বর্গীয় রাধারমণ গোস্বামী কেন্দুবিল্ব গদির প্রতিষ্ঠাতা।
- ডক্টর হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এর অভিমত।
রাধারমণ গোস্বামী নিশ্চিত ভাবেই জেনেছিলেন যে এই কেন্দুলী ই কুলগুরু কবি জয়দেবের জন্মগ্রাম। তাই তিনি
এখানেই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।
কেন্দুলী নিয়ে উড়িষ্যা র দাবী নানা ভাবে ই খণ্ডিত হয়ে গেছে।
তাই সে প্রসঙ্গে প্রবেশের দরকার নেই।

বাউলদের মেলা ঃ সাধারণ মানুষের মেলা।  বৈষ্ণব দের মেলা। আবার বাউল দের ও মেলা।
অনেকে বলেন এই মেলা হল " বাউলদের বাৎসরিক উৎসব "
ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন " খ্রীষ্টীয় অষ্টাদশ শতকে শ্রী নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র সহজিয়া দের বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে নিয়ে আসেন। তাঁরা তখন বৈষ্ণব সহজিয়া সম্প্রদায়। আর তাঁদের থেকেই এসেছেন বাউলেরা। "
শুধু মাত্র বাউলেরা নয়। আউল ; বাউল ; বৈষ্ণব ; নেড়ানেড়ি ; সতুয়া ; সাঁই ; দরবেশ ; ফকির - নানা ধরনের সম্প্রদায়ের
মানুষ এই মেলায় আসেন। এখন শিখ ধর্মের মানুষেরাও মেলায় মহোৎসব এর আয়োজন করেন।
আসলে জয়দেব সকলের। সব সম্প্রদায়ের। তিনি নাথ যোগী ;
কায়া সাধক ; পঞ্চোপাসক ; যোগী ; সহজ সাধক।
তিনি বুদ্ধ কে দশাবতারের মধ্যে স্থান দিয়েছেন। আবার গুরু গ্রন্থ সাহিবে ও তাঁর পদ রয়েছে। স্বাভাবিক ভাবে শিখরাও
তাঁকে পরম ভক্তি প্রদর্শন করেন।
ডক্টর সুকুমার সেনের মতে তিনি  " আধুনিক আর্যভাষার আদিকবি "
তিনি " পদ্মাবতী - চরণ - চারণ - চক্রবর্তী  "
তিনি " কেন্দুবিল্ব সম্ভব রোহিনী রমণ '
তিনি আমাদের প্রাণের ধন।
রাধাবিনোদ মন্দির ঃ  বিখ্যাত  টেরাকোটা শোভিত এই বিশাল মন্দিরটি র সম্পর্কে বীরভূম জেলা গেজেটিয়ারে
বলা হয়েছে " according to an inscription on a tablet
was built by the mother of Maharaja Kirti Chand Bahadur of Burdwan and dedicated to the god in Sakabda 1605.
বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচাঁদ বাহাদুরের জননী ভক্তিমতী
ব্রজকিশোরী দেবীর দ্বারা এই মন্দির নির্মিত।
অনবদ্য এর টেরাকোটা র কাজ। মূলত পৌরাণিক কাহিনী র
চিত্ররূপ কে অপরিসীম কুশলতায় শিল্পী রা নির্মান করেছেন।
এখন আর সম্মুখ ভাগেই টেরাকোটা র কাজ দেখা যায়।
রাম রাবণের যুদ্ধ কাহিনী ছাড়া ও বেশ কিছু সামাজিক চিত্রণ
উল্লেখযোগ্য। মন্দির দেওয়ালের কোনের মৃত্যুলতা বা বর্শা
বেশ পৃথক ধরনের। খুব দ্রুত ক্ষয় প্রাপ্ত হচ্ছে এই সব অলংকরণ। মন্দির দেওয়াল গাত্রের উত্তর ; পূর্ব ; পশ্চিমে র
দিকে নূতন করে প্লাষ্টার করা হয়েছে।
এই মন্দিরের প্রবেশ পথে প্রাচীন মন্দিরের শিলাখণ্ড চৌকাঠ হিসাবে রক্ষিত আছে।
মন্দির টি ভারতীয় পুরাতত্ব বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত।
ও ম্যালির জেলা গেজেটিয়ার অনুযায়ী " The body of Jayadeva was buried and not burnt after his death ;
and his tomb is still to be seen at kenduli ; surrounded by beautiful groves and trees "
আজকের জয়দেব কেন্দুলী ঃ সার্ভেয়ার জেনারেল রেণেল সাহেবের ১৭৭৯ সালের ম্যাপে কেন্দুলী র উল্লেখ নাই।
পার্শ্ববর্তী ব্যবসা বাণিজ্য কেন্দ্র কোটা শীর্ষা ; জনুবাজার এর
উল্লেখ রয়েছে। কেন্দুলী বা তাকে ঘিরে ছোট ছোট কয়েকটি
পাড়া ; বা গ্রাম নিয়ে ১৯০১ সালের জনসংখ্যা মাত্র ৭৭১।
আজকের জয়দেব কেন্দুলী কিন্তু আকারে প্রকারে অনেক
বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন এক জমাট গঞ্জ। অজয়ের ওপারে সেনপাহাড়ী পরগনার বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ বাজার করার
জন্য এখানে আসেন। অজয়ের উপরে অস্থায়ী পারাপার ব্যবস্থা করা হয়। কয়েক বৎসরের মধ্যে পাকা সেতু নির্মিত হবে। তার কাজ চলছে।
ওপারে সেনপাহাড়ী ঃ অজয়ের দক্ষিণ তীরে সেনপাহাড়ী জঙ্গল ভূমি। সেন রাজাদের পূর্ব পুরুষ দের আদি বাসভূমি।
ডক্টর সুকুমার সেনের মতে তাই নাম ' সেনপাহাড়ী "।
এই স্থান সেন রাজাদের পূর্ব পরিচিত। পাল রাজাদের আমলে র  সীমান্ত রক্ষার জন্য এখানে যে গড় ছিল - যা পরবর্তী সময়ে
দুর্দমনীয় ইছাইঘোষ এর দখলে যায় এবং পরবর্তী কালে
সেই গড় সেন রাজাদের অধীনস্থ হয়
এই ঘন ঘোর জঙ্গল ভূমিতে তখন অনেকে তন্ত্র সাধনা করেন।
কায়া সাধন বা নারী কে  সঙ্গিনী করে দেহ সাধনা। ' দেহভাণ্ড ই ব্রহ্মাণ্ড "। দেহসুখের মাধ্যমে চিত্তসুখের সন্ধান "।
দীর্ঘ জীবনের আশায় রাজা বল্লালসেন ও এখানে আসতেন।
নিম্নবর্গের নারী পদ্মিনী র সাথে সংসর্গের জন্য পিতা পুত্রের
মনোমালিন্য ঘটে। তখন রাজা লক্ষ্মণ সেন বেশ কিছু দিন
এখানে এই গড়ে এসে অবস্থান করেছেন। সম্ভবত এখানেই
রাজা লক্ষ্মণ সেনের সাথে কবিবর জয়দেব এর সাক্ষাৎ হয়।
জয়দেবের কবিত্বে সুপণ্ডিত রাজা লক্ষ্মণ সেন মুগ্ধ হন।
তিনি গীতগোবিন্দমের সুললিত পদ শুনে মোহিত হন।
তাঁকে রাজধানীতে আমন্ত্রণ জানান। এবং তাঁর রাজসভার
কবি হিসাবে মনোনীত করেন।
     " যদি হরিস্মরণে সরসং মনো
      যদি বিলাসকলাসু কুতুহলম
      মধুরকোমলকান্তপদাবলীং
      শৃণু তথা জয়দেবসরস্বতীম্
----------------- ------------ ------------ ------------ ------------ সমাপ্ত।
চিত্রঋন। সত্যশ্রী উকিল। 












 

বিধাতা পুরুষ। কথা - সাতকাহন


।।  কথা - সাতকাহন।।
বিধাতা পুরুষ।
কেমন সে বিধাতা পুরুষ! 
তাকে দেখতে হবে। আজ ষষ্ঠী। রাতের কোন প্রহরে এসে
তার ছেলের কপালে তিনি  কি লেখেন তাকে জানতে হবে।
এ মা একটু ছোট থেকেই ডাকাবুকো। ভয় ডর নাই বললেই
হয়। ছেলেদের মতো গাছে চাপা। সাঁতার কাটা। সমুদ্রের  ঢেউ নেওয়া। সবেতেই দামাল। স্বাস্থ্য ও ভালো।
আর বুদ্ধি। প্রখর। অঙ্ক কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়। তখনকার দিনে অঙ্ক। মানে পাটীগণিত। চতুর্থ শ্রেণী তেই শতকরা ; সুদকষা ; ভগ্নাংশ। সিঁড়ি ভাঙ্গা সরল। সরল কর। সে বলত
' সরল কিন্তু সরল নয়কো মোটেই '। যদিও সে সরল করত
সে যেমনই গরল হোক না কেন।
এই যে মেয়ে মা হয়েছে বেশ কিছুটা সময় পরে।
সংসারে উদাসীন স্বামী। শ্বশুর বাড়ির পরিবেশ ও তার মনোমত হয়নি। তবু যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে মানিয়ে নিতে।
  বাচ্চা হবার জন্য বাপের বাড়ি তে আসা। তখন তো বাড়িতেই
প্রসব। ধাইমা দের হাতে।
ঘরের মেঝেতে মাদুর পেতে শোয়া। পুব দিকে মাথা। মাথার কাছে জ্বলছে প্রদীপ দানিতে প্রদীপ। পাশে তার বাচ্চা। অতি ছোট খাটো একটা পুঁটলি যেন।
মা রাত জাগছে। এখন কত রাত কে জানে। ঘরের বাইরে বারান্দায় শুয়ে আছে সেই মায়ের মা।
ভোর রাতের দিকে সে যে কি দেখেছিল সে ই জানে। মুখ দিয়ে
একটা ভয়ার্ত আওয়াজ বের হয়েছিল। তারপর অজ্ঞান হয়ে
গিয়েছিল। তার পরদিন আর কারও সাথে কোন কথা বলেনি। নিজের মধ্যেই আত্মস্থ হয়ে ছিল।
তার একদিন পরে থেকে শুরু হল জ্বর আসা।
তখন এই এলাকায় ভূতনাথ দালাল। তিনি ই চিকিৎসা করেন।
জ্বর কমে। বাড়ে। দুপুরের পর জ্বর আসে।
অগত্যা ইলামবাজার এর কালীবাবু। তিনি এল ; এম ; এফ পাশ করা ডাক্তার। তাঁর চিকিৎসায় জ্বর ভালো হল কিন্তু শরীর খুবই দূর্বল।
সেই দূর্বলতা সহজে কাটলনা।
কয়েকমাস পরে ছেলেকে কোলে নিয়ে যেতে হল নিজের স্বামীর ঘরে।
নিজের মেজো বোন তখন একটু বড় হয়েছে। ছেলেকে আগলাতে পারবে। এই ভাবনায় নিজের বোনকে নিয়ে গেল সাথে করে।
শিশুর যত্ন তাও ঠিক মতো হয়না। কেউ মুখ বাঁকিয়ে বলে
" বার্লি তেই হবে  দুধ চাইনা "।
কিন্তু রোগ জ্বালা হলে ওষুধ তো চাই। গ্রামে পুইতণ্ডী ডাক্তার আছেন। যাই হোক মিকশ্চার দেন।
রান্না বান্না করার মতো শারীরিক ক্ষমতা নাই।
মেজবোন যেমন পারে তেমন করে।
তা আবার জামাইবাবুর পছন্দ হয়না। কড়া কথায় কান্না আসে
মেজ বোনের চোখে।
  সংসার ; স্ত্রী পুত্র দের বা শ্যালিকার প্রতি মন দেবার মন নাই। মন যে তার কোথায় কোনখানে তার হদিস হয়তো সে জানে কিম্বা হয়তো জানেনা।
দাদা মানুষ টি র মমত্ব আছে। ভাই কে বকাবকি করেন।
সংসারে মন দিতে বলেন। পূজা পাঠের পরেও সংসারে মন দেবার সময় অনেক আছে।
ভাসুরের ছেলে কেষ্ট   মেজবো নের বয়সী।
সে তার সাধ্যমতো সাহায্য করে।
বড়জা সুন্দরী। তার গর্ব আছে। স্বামী কুলটি কারখানায় কাজ করে। তার মাসমাহিনা আছে। পরিবারে কর্তৃত্ব প্রবল।
আর এই বাবু রাগারাগি করে কোলিয়ারীর চাকরি ছেড়েছেন।
ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ছেলে। পূজা পাঠ নিয়েই থাকবেন।
তাতে কি আর আয় তখন!  ভালো কিছু শিষ্যবাড়িতে খাতির ছিল খুব। সেখানেই কেটে যেত বেশ কয়েকদিন।
  এদিকে তার স্ত্রী র  ; সেই মায়ের আবার জ্বর আসছে।
প্রায় প্রত্যেকদিনই কাঁথা চাপা দিয়ে পড়ে থাকা।
আর যন্ত্রণা বাড়ে এগারো বারো বছরের বোনের। এত কাজ সে পারে। চোখে জল আসে। দিদি   বলে   'কি করবি বল '
একটু কষ্ট কর। বাবাকে চিঠি লেখ। আমাকে এখান থেকে
নিয়ে যাক "।  হয়তো কোন এক চিঠি পৌঁছেছিল।
  দিদির অযত্ন ; জামাইবাবুর ব্যবহার প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করেছিল
সেই মা য়ের ভাইকে। সে ভাই সেখানে গিয়ে রাগের মাথায়
গোটা পরিবার কে '  যা কথা শোনানোর শুনিয়ে ' রাগে গজগজ করতে করতে ; পাড়ার লোকদিকে ডেকে জানিয়ে
  বোন ; দিদি আর তার পুঁচকে বাচ্চাটা আর বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে চলে এলো  বাপের বাড়ি তে।

সেই মা কি জানত এই তার শেষ যাওয়া!
  সে কি জ্বরগ্রস্ত শরীরে পিছন ফিরে তাকিয়েছিল!
তার স্বামী কি তাকে স্কুল মোড়ের যেখান থেকে একটি বাস ছেড়ে যায়  সেই জায়গা পর্যন্ত এসেছিল!
তাদের বিদায় জানাতে!
কে জানে!

------------ ------------ ------------ ------------ ------------ এই পর্ব শেষ।




 

বুঝলি মহাদেব সে সব কথা কি আর কারও মনে আছে না কি


।। কথা - সাতকাহন।।
বুঝলি মহাদেব ; আজ আর কারও সে সব কথা মনে নেই।
বা সে সব কথা কেউ মনে ও আনবে না। আনবে ই বা কেন।
যে দিন গেছে  সে দিন গেছে ই। মনে রেখে লাভ কি বল।
  তোকে উদ্দেশ্য করে বলছি এই জন্যে যে তোর মনে আছে
  সব। বরং আমার ভুল হতে পারে।
  তুই আর আমি। ব্যস। আর কারও দেখা নাই। ' ও ওরা দুজনেই যথেষ্ট '।
চার পাঁচ টা রঙের কৌটো। আর একটা য় অনেক টা পাতলা
সাবু র আঁঠা। তাতে রঙ গোলা হয়। এ কাজটাও শিখতে হয়।
তুই শিখে নিয়েছিলি। গাঢ় গিরি রঙের এলামাটি ; মেটে হলুদ
পিউড়ি হলুদ ; নীল বা ব্লু আল্ট্রামেরিন ; আর কাগজের প্যাকেটে ভুসো কালি ; সামান্য একটু মিনে লাল।
এই সামান্য উপাদানেই ঝকঝক করত দেয়াল গুলো।
লেখায় ; ছবিতে। কার্টুনে। রঙে ভেজানো সুতলি ধরে লাইন সোজা করে নেওয়া হত। ভালো হত আর একজন থাকলে।
তো সে আর কাকে মিলবে বল।
যাইহোক  সেবারের কৃষক সভার সম্মেলন উপলক্ষে অযোধ্যা হাই স্কুলের বাইরের পাঁচিলের নীচু দেয়াল ভরিয়ে দেওয়া হল
মনীষী দের ছবিতে। একেবারে পোর্টেট।
মার্কস ; এঙ্গেলস ; লেনিন ; স্ট্যালিন তো আছেনই। আরও আছেন বিদ্যাসাগর ; রবীন্দ্রনাথ ; রাহুল সাংকৃত্যায়ন।
পেশাদার হাতের আঁকা লেখা যেমন হয় আর কি।
স্কুলের ভিতরে প্যাণ্ডেল করে প্রতিনিধি সম্মেলন।
প্রতিনিধি রা তো এই রকমের সজ্জা ; আঁকা লেখা দেখে
একেবারে হাঁ। আগে কখনো এমন দেখেই নি প্রায়।
আর নেতারা দেখছেন কিন্তু তাঁদের তো আর ভালো লাগা বা মন্দ লাগা মুখ ফুটে প্রকাশ করতে নেই।
সাধারণ প্রতিনিধি রা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।
কাঁকসা থানা কৃষক সভার প্রথম জমাট করে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সবদিক থেকে জমাট সম্মেলন মানে নেতাদের
পদোন্নতি।
কো - অপারেটিভ চত্বরে রান্না বান্নার বিরাট আয়োজন।
ভাণ্ডারী ; রান্নার লোক ; পুরুষ ;মহিলা সহকারী  সব মিলিয়ে
হৈ হৈ ব্যপার।
অবশ্য তার আগেই আমাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে।
নেতারা সবাই এসেছেন। সেই সম্মেলনে প্রথম দেখেছিলাম
  কমরেড রবীন সেন কে। রাশভারি মানুষ। সুগারের রুগী।
তিনি প্রতিদিন  করলা পাতার রস খান। তার ও ব্যবস্থা হয়।
  এই রান্না শালার সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব কমরেড মোহন চ্যাটার্জি র।
আর রান্না শালায় তিনি জুটিয়েছেন এমন সব মানুষ কে - সে এক বিচিত্র সমাহার। যার দখলে রয়েছে অন্যের খাস জমি
তিনিও দেখি খুন্তি ধরেছেন। সাবাস।
যার ভালো কিন্তু গোপনে সুদের কারবার সে ও জুটে গেছে।
না জুটে গেছে নয়। তাকে ভাণ্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সে মানুষ মোটেও খারাপ নয়।
আরও কত মানুষ কে জোটানো হয়েছে। সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।
  এত বড় একটা ব্যাপার।
  কাজ সুসম্পন্ন করতে হলে অনেক কে চাই। আর অনেক কে
জোটানো টা ও  একটা গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কাজ।
মানুষ কে তো চাই।
বেশ কিছু মহিলা। তাদের তো চাই ই চাই। অযোধ্যা বনকাটি
সাতকাহনিয়া গ্রামের গরীব মানুষের ঘরের মহিলারা।
রান্না শালায় তাঁরা অনেক কাজ করেন। তাঁদের বাদ দিয়ে
হয়না। আর নানা রকমের গল্পে মাতিয়ে রাখার মতো মানুষ
কিছু লাগেই। পরিশ্রম অনেক হাল্কা হয়ে যায়।
  তেমন কিছু মানুষ জুটেছেন। মেয়েদের নিয়ে চমৎকার গল্প জুড়েছেন। আগামী তে এলাকার মহিলা সমিতি র নেত্রী হবেন
তিনি  খুব ব্যস্ত। তাঁর দলের মেয়েরা চা জল পরিবেশন করছেন সম্মেলন কক্ষে। খবর নিচ্ছেন ঘন ঘন। খাবার বিরতি
কখন ইত্যাদি।
বেশ একটা জমজমাট পরিবেশ।
মাঝে মাঝে নেতারা এসে দেখে যাচ্ছেন। আগামীর নেতাদের
উৎসাহ বেশী। " কি দাদা কতদূর " - । আরে বাব্বা এত্তো  আয়োজন "  ইত্যাদি বাক্যালাপ ।
এসব বলার জন্যেই বলা। যে বলছে আর যারা শুনছে সবাই
বোঝে -
ঐ কিছু বলা। এর ভিতরে ই লুকিয়ে থাকে প্রশংসা।
  আয়োজক দের কর্তার বুক ফুলে ওঠে।
সম্মেলন শেষ হল যথা নিয়মেই। বিধি সম্মত ভাবেই।
এই সম্মেলন থেকে একাকার দুজন নেতা উঠে এলেন থানা কমিটি তে।
আগামী দিনের এখানকার রাজনীতি কোন দিকে গড়াবে তাও
স্থির হয়ে গেল এই সম্মেলন থেকে ই।
------------ ------------ ------------ ------------ ------------ ------------
চিত্র ঋন। ওয়াসেফ জামান 
 

শ্রীনিকেতন। ইলামবাজার। অজিত গুঁই। গালা শিল্প। ইউসুফ আলী।


ইলামবাজার।  গালা শিল্প । অজিত গুঁই এবং তাঁর ছাত্র ইউসুফ ভাই  ও অন্যান্য কথা।
- --------৷  -----------------------------------------------------------------------

আমাদের এক পা এপারে আর এক পা ওপারে।
মাঝে বয়ে যায় অজয়।
দু  বেলা পারাপার।
যখন অজয় সেতু ছিলনা ; তখন ছিল অস্থায়ী পারাপারের ব্যবস্থা। কিছুটা কাঠ বাঁশের সাঁকো। কিছুটা নৌকো। বাগুড়া
গ্রামের ভিতর দিয়ে মোরাম রাস্তা। নদী চর এর উপর দিয়ে
একেবারে সাঁকো পর্যন্ত।
  তারপর অজয় সেতু র উদ্বোধন হল ১৯৬২ সালে। মুখ্যমন্ত্রী
ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় উদ্বোধন করলেন। বহু মানুষ দেখতে গিয়েছিলেন। সবার ই খুব আনন্দ। এপার আর ওপারের যে নিবিড় সম্পর্ক। বর্ষা য় পারাপার বন্ধ হয়ে গেলে বড় কষ্ট মনে।
মাতামা ; দিদিমা র কোলে চেপে বা গোরুর গাড়ি তে সেই কবেকার ছোট বেলা থেকে ইলামবাজার যাওয়া।
দল বেঁধে হেঁটে যাওয়াই ছিল বুঝি আনন্দ।
সিনেমা দেখতে যাওয়ার আনন্দে পথ হাঁটার কষ্ট হারিয়ে যেত।
  প্রথম সিনেমা হল চালু হয়েছে ইলামবাজারে।
  বলছি যখন বলেই নি - আমার স্মৃতি তে আছে একটা ঘটনা।
  সিনেমার নাম ' মরুতীর্থ হিংলাজ '।
  রাতের অন্ধকারে পথ হাঁটছে তীর্থযাত্রীর দল। মরুভূমি র উপর দিয়ে। স্ক্রিনে সেই অন্ধকার যাত্রা।
হলের দর্শক দের চিৎকার ' আলো কই। আলো দাও  হে '।
হট্টগোল। তারপর বোধ হয় মাইকে বলা হল 'রাতের দৃশ্য '।
এমন ই হবে। '
কিছু দর্শক বোধহয় বেরিয়ে গেল।
আমাদের বাড়িতে দাদু দিদিমার ততদিনে অবধূতের সেই বিখ্যাত  বই পড়া হয়ে গেছে। সে ও কিছুটা শুনেছে।
অ্যাটলাস এর ম্যাপ বই নিয়ে বসে যায় কোথায় হিংলাজ খুঁজতে। এটা তার খুব প্রিয় ছিল। খোঁজা। কত সাল কি জানি সে আর তার  মনে নাই। তবে চণ্ডীচরণ চট্টোপাধ্যায় কোম্পানির  সে ম্যাপ বই এখনও আছে। আহা কি সুন্দর ছিল
সে ম্যাপ বই।
যাই হোক অযোধ্যা জুনিয়র হাই স্কুল থেকে ক্লাস এইট পাশ করে ইলামবাজারে গেল ক্লাস নাইন থেকে পড়তে। সে তো আরেক কাহিনী। সাইকেল চাই। নাই। দাদু চিঠি লিখল বাবাকে। বাবা একমাস পরে একটা সেকেন্ড হ্যাণ্ড সাইকেল ;
কিন্তু ভালো কন্ডিশনের  এনে দিয়ে গেল। সেন র‍্যালে কারখানার পাশ দিয়ে এলেও সে সাইকেল ছিল হারকিউলিস।
  একটু উঁচু।  সে সব কথা ' কথা - সাতকাহন ' এ কোন পর্বে লিখেছে।
এই এলাকা থেকে যেত তারা পাঁচ জন।
  অজয়ের নদী বাঁধ ধরে। সে বাঁক গুনতে গুনতে যেত আর বাঁধের গায়ে গায়ে প্রাচীন শিমুল গাছ গুলিকে গুনতে গুনতে।
  শতাব্দী প্রাচীন সে সব গাছ। বিপুল তাদের গুঁড়ির বিস্তার ; খাঁজ।
  ইলামবাজার হাই স্কুলের দোতালায় একেবারে পূব দিকের ঘরে ক্লাস নাইন। সে ছিল বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। কিন্তু বাংলা ; ইংরেজি একসাথে। স্কুলের পিছনে গেরুয়া রঙের জলের পুকুর । তার নাম ' লরি পুকুর '। তার উত্তরে প্রাইমারি স্কুলের পিছনের পুকুর টির ও নাম ' লরি পুকুর '।পরে জেনেছে আরও আছে। মনে প্রশ্ন ' লরি পুকুর '। এমন নাম কেন?  বাস লরি জানে। তার সাথে কি সম্পর্ক! কারও কাছ থেকে তো জানতে হবে।  আরও বেশ কিছু দিন পরে মাষ্টার মশাই কিরীটী বাবুর কাছ থেকে জেনেছে ' লরি ' রা ছিল গালার কারবারি। গালার
জিনিস তৈরী র কারিগর। তারা কারা?  ' লরি ' বা ' নুড়ি ' কারা।  কেউ কিছু ই বলে না। কেমন যেন লুকোছাপা ভাব।
অনেক পরে জেনেছে ' গুঁই ' রা ' দাস ' রা 'পাল ' রা এরা সব
  'লরি '। এখন আর এরা কেউ' লরি ' বলে পরিচয় ও দেয়না।
আর পদবী বা পেশা সব বদলে নিয়েছে। এখানেও সেই জাতের প্রশ্ন। নীচু জাত। অথচ তার বেশ কয়েকজন বন্ধু রয়েছে  সেই পাড়ার। তাদের বাড়ি তে ও গেছে। কে আর সে পরিচয় দেয়। কেন ই বা দেবে। সদ্য যুবক প্রয়াত রাধাশ্যাম গুঁই
অঙ্কের শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছেন হাই স্কুলে।
এই গুঁই পরিবারের বিখ্যাত গালা শিল্পী গোপাল ও নেপাল গুঁই কে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে গিয়েছিলেন শ্রীনিকেতন শিল্প সদনে গালা শিল্পের প্রশিক্ষক হিসাবে। তাঁদের ই উত্তর পুরুষ অজিত গুঁই।
তিনিও কিছুদিন প্রশিক্ষণ দান করেছিলেন। তাঁর ই প্রত্যক্ষ ছাত্র শ্রীনিকেতন সুরুলের মসজিদ পাড়ার শেখ ইউসুফ ভাই।
তাঁরা স্বামী স্ত্রী গালা শিল্পের গুণী শিল্পী। চমৎকার তাঁদের হাতের কাজ। বীরভূম আর্টিসানি নামক সংস্থা একদিনের প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করেছিলেন। হাতে কলমে কাজ
শেখার জন্য। বেশ কয়েকজন শিল্পশিক্ষার্থী যোগ দিয়েছিলেন। সংস্থা র পক্ষে অভিষেক সেনগুপ্ত আমাকে বিশেষ ভাবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন। বিশেষ আমন্ত্রিত ছিলেন ' রাঢ় ভাবনা ' পত্রিকার সম্পাদক মাষ্টার মশাই সৌরেন্দ্র নাথ  চট্টোপাধ্যায়। শিল্পী বিধান বিশ্বাস ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা।
ইউসুফ ভাই এর কাজ দেখলাম সারা দিন বসে। এই প্রথম
হাতে কলমে কাজ দেখা। তিনি যখন তাঁর মাষ্টার মশাই অজিত গুঁই এর কথা বলছিলেন - কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠছিল
তাঁর চোখ মুখে। আর আমি ভাবছিলাম - না ; মরেনি। ইলামবাজার এর গালা শিল্পী রা বেঁচে আছেন ইউসুফ ভাই এর মধ্যে। কিন্তু এই কাজ করে সংসার চলেনা তাঁর। তাঁকে টোটো ও চালাতে হয়। হায় রে। আমরা কি পারিনা সম্মিলিত উদ্যোগে
এই গালা শিল্প কে বাঁচাতে। পারিনা ইলামবাজারের ' চৌপাহারী' জঙ্গল ভূমির মধ্যে বাস করা আদিবাসী পল্লী গুলির ' স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী ' গুলির মহিলা দের মাধ্যমে লাক্ষা কীটের চাষের মাধ্যমে গালা র উৎপাদন করতে বা জেলা শিল্পদপ্তরের মাধ্যমে তা বাজার জাত করতে।
  ভেবেছি অনুরোধ জানাব ইলামবাজার ব্লক প্রশাসন কে ভেবে দেখার জন্য। আমার ধারণা প্রশাসন সচেষ্ট হলে এই প্রয়াস সার্থক রূপ পাবে।
-------------------------------------------------------- ©  প্রণব ভট্টাচার্য
  জীবন ই শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। সারা জীবন ব্যাপী ই শিক্ষা গ্রহণ।
    আজীবন ই আমি ছাত্র। মানুষের মাঝেই ছড়িয়ে আছে শিক্ষা। সকল শিক্ষক কে আমার প্রণতি। সকল শিক্ষার্থী কে আমার ভালোবাসা।
  
 

সাতকাহনিয়া গ্রামের দশহরা উৎসব

।। সাতকাহনিয়া গ্রামের দশহরা উৎসব।। 

 নীলবাড়ির মাঠ আর কলাবাগানের ঘাট। 
 নদী স্নানে দেবী যান  অজয়ে। 
দেয়াশী রা বা যদি কারও মানসিক থাকে 
 তাঁরাই কোলে করে নিয়ে যান বিমূর্ত 
 চেহারার  দুই দেবী মূর্তি কে। নদী থেকেই 
 তাঁদের পাওয়া গিয়েছিল। সে অনেক দিন আগের কথা। 
 পিছনে ছাতা ধরে থাকেন একজন। চামর; ধূপ ;ধুনো। ঢাক ; ঢোল বাদ্যি। 
 সামনে বাজনদার এর দল। 
 পিছনে মানুষের ঢল। 
 সেবাইত অযোধ্যা গ্রামের ধীবর রা। 
 একদিন এই গ্রামেরই  বাসিন্দা ছিলেন তাঁরা। 
 নানা গ্রামে ছড়িয়ে থাকা তাঁদের আত্মীয়রা
 আসেন এই উৎসবে। শ্রীচন্দ্রপুর ; ইলামবাজার থেকে। 
 আসেন ডাঙ্গাল গ্রামের গঁড়াই রা। 
 একদিন তাঁরা এই গ্রামের মানুষ ছিলেন। 
 আদুরিয়ার  এক মণ্ডল পরিবার। 
 আরও অনেক অনেক গাঁয়ের মানুষ। 
 অনেকের মানসিক থাকে। পাঁঠা নিয়ে আসেন।
 অনেক বলি হয়। 
 আমাদের ছোট বেলায় দেখেছি হালদার বাবুদের 
 বাড়ি থেকে বড় গামলা ভর্তি চিঁড়ে ভোগের আয়োজন করা হত। 
  নীল বাড়ির মাঠে " ষোট " খেলা খুব জমে উঠত। 
  " ষোট " একধরনের কাবাডির মতো ই। 
 নরম ; চষা মাটিতে খেলার মাঠ। 
  পুরনো দিনের সেই মানুষ গুলো কে খুব  মনে পড়ে। 
  বটূ কোঁড়া ; দুলাল কোঁড়া ; ষষ্ঠী বাউরি ; গুডু মাল 
  ভক্তি কোঁড়া ; চণ্ডী বাউরী ; 
  এই রকম সব কত নামের মানুষ। 
  আর পেটে তালতাড়ি তো পড়তই। 
  চারদিকে লোক দাঁড়িয়ে " অব্বো অব্বো " মানে 
 মুখে শব্দ করে বাহবা দেওয়া - দিত। 
 খেলা আর শেষ হতে চাইতনা। যত জমে তত বাহবা। 
 চিঁড়ে ভোগ খেয়ে নদী চান শেষ করে তারপর ফেরা। 
  ফিরতে ফিরতে বেলা ঘুরে বিকেল। 
গাঁয়ের মাঝে প্রাচীন   বাবাজী বটতলা।  
অনেক নাম তার।  ডালিপুজোর বটতলা 
 দাঁড়ি পুজোর বটতলা। পশ্চিম দিকে ছিল গন্ধেশ্বরী থান। দু থাকের বেদী। 
 তাম্বুলী সমাজের দাঁড়িপাল্লা পুজো। ডালিতে করে 
প্রসাদের ফলমূল ; নৈবেদ্য আনত তাম্বুলী সমাজের
 ব্যবসায়ী রা। এ পুজো হত অবশ্য অঘ্রান মাসে। 
 বটতলা ঘিরে অনেক টা ফাঁকা জায়গা। 
 সেই বটতলার পাশেই মনসা মন্দির। ছিল ছোটখাটো  মাটির একটা ঘর। 
  পরে একটা ছোট্ট  দালান । তারপর পালি ভাগাভাগি। 
 হল আর একটা দালান মন্দির। আর এক তরফের। 
 পাশে এক ঝাঁকড়া পলাশ। ঘৃতকুমারী ; 
  বাঁশ ; আতা র ঝোঁপ আর কয়েকটা তাল গাছ। 
 সামনে কাঠের খুঁটির উপরে এক আটচালা। নীচেটা পরে 
 সিমেন্ট বাঁধানো হয়েছিল। তার সামনে যূপকাষ্ঠ। 
 সেই আটচালাতে মনসামঙ্গল গান হয়। বেহুলা লখীন্দরের পালা। 
 আগের দিন রাত থেকে গান আরম্ভ হয়। 
 দ্বিজ বংশীদাস ; কেতকা দাস ক্ষেমানন্দ এর পদ।

 গাইতেন ডাঙ্গাল গ্রামের দাস বৈরাগীর  দল। 
 একটি ই মিষ্টি র দোকান বরাবর বসে। 
 এক দুটি মনোহারী দোকান। 
চৌকিদার  কুমারিশ ডোম।  বানফোঁড়ার ওস্তাদ। 
 সে আসত। আর আসত অযোধ্যা বাগদি পাড়ার      এক দু জন ওস্তাদ । একদল যুবক ছেলে  বান ফুঁড়ত। 
 নদী ধারেই বাণ ফোঁড়া হত। সেখান থেকেই নাচতে নাচতে 
 গ্রামে ফেরা। সাথে মানুষের দল। থানের সামনে এসে অনেক ক্ষণ 
 চলত বাণ ফোঁড়া দের নাচ। বাতাসা ছড়ানো। সাথে ঢাক ঢোল তো আছেই। গাঁয়ের মুসলিম পাড়ার মেয়ে বৌ রাও আসত মেলা দেখতে। পুরুষ রা তো আসেই। উৎসব তো সকলের ই। 
 শেষ ই হতে চায়না। আরও। আরও। 
 তারপর ছাগ বলি র পর্ব। 
 যেবারে বেশী থাকে সেবারে দেরি হয়। 
 ছাগ বলি শেষ হলে মোটামুটি শেষ হয়ে আসে। 
 তারপর আবার সব ঘরে ফেরা। সন্ধ্যা নামব নামব। 
 গাঁয়ের লোকেরা কিছুসময় বটতলায় থাকে। কিছু কেনাকাটা করে। ছোট্ট গাঁয়ের একদিনের উৎসব। ঘরে ঘরে কুটুম জন থাকে। রাত টা আনন্দে ই কাটে। ভাত মুড়ি তালতাড়ি ;আর কচু কুমড়ো র তরকারি। অল্প মাছও জোটে কারও কারও। বা প্রসাদী মাংসের টুকরো। হালদার বাবুদের বাড়িতে ছোট খাটো 
 ভোজ। বলির গোটা  পাঁঠার মাংস ; খিচুড়ি ; তরকারি। হয়তো নেমতন্ন হবে। 

 এই দশহরা পরব টা এলেই আমার ছেলে বেলার
 কথাই মনে পড়ে। 
 নদী ধারে গিয়ে পশ্চিম দিকে তাকিয়ে থাকতাম। 
 মাতামা অন্নপূর্ণা মাসীমা রা দশহরা কবে পাঁজিতে দেখত। 
 পাঁজি টা তে আমার খুব আগ্রহ। কত রকমের ছবি থাকে। 
 দশহরা র ছবিতে দেখতাম  হাঙর এর উপরে এক সুন্দরী চেপে জলে ভেসে আসছেন। মাতামা বলত  মকর বাহিনী গঙ্গা। 
 নদী তে অল্প জল বাড়ত। মাটি গোলা ঘোলা জল। জলে নামতে ভয় লাগত। পশ্চিম দিকে তাকিয়ে থাকতাম। নদীটা তো ঐদিক থেকে আসছে। আমার মনে হত ঠিক ঐ রকমের 
 মকরের পিঠে চেপে সুন্দরী জলদেবী ভেসে আসবেন। 
 তারপর একটু বড় হলে বুঝলাম  না আসবেনা। কখনও আসেনি। জলে নামতে আর  ভয় পেতামনা। একবার চিৎ সাঁতার দিয়ে জলের টানে নীচে দিকে অনেক দূর  গিয়েছিলাম চলে। 
 তিন চার জন মিলে। তারা আজ আর কেউ নেই। 
 আমিও আর যাই না। 
 কতদিন যে যাই নি। 
------------  ------------ ------------ ------------ ------------ 

আমি সেই পুরনো দিনের কথা বললাম। এখনকার নয়। 
 এখন গরীব ঘরের যুব ছেলে দের খুব উৎসাহ। উৎসাহ নিয়ে 
 পরব টা কে জমাবার চেষ্টা করছে। বেশ কিছু দোকান বসাচ্ছে। বাইরের শিল্পী এনে বাউল সহ আধুনিক গানের 
 ফাংশান হবে। গ্রামের গরীব ঘরের ছেলেরা বালির ট্রাক থেকে 
 টাকা কালেকশান করে বিরাট মন্দির বানাচ্ছে। 
 খুব উৎসাহ তাদের। তাদের কথা পরে বলব। 
  ------------ ------------ ------------ ------------ দশহরা। ১৪২৯ সন। বৃহস্পতিবার।

Monday, 6 June 2022

মোতি চাচা আর তার নতুন হাম্বার সাইকেল


।।কথা সাতকাহন।। নবম
র‍্যালে কোম্পানির নতুন ' হাম্বার ' সবাইকে কিনে মোতি চাচার কি আনন্দ। গাঁয়ে আর কারো নাই।প্রচ্ছন্ন গর্বে দুবেলা কাঁধের গামছা দিয়ে সাইকেল টা মোছে। একেবারে চকচকে ঝকঝকে। ওর চোখ দুটো ও চকচক করে ওঠে।
তাকে আজ আর কারও মনে নাই। মনে রাখার কারণ ও নাই। ডাকবাংলো র সামান্য কুলি মজুর। খালাসি।
ঠিক সকাল সাড়ে সাতটা য় সে হাজির ডাকবাংলো অফিসের বারান্দায়। বাবু ডাকলে অফিসে র ভিতরে ঢোকে টিপছাপ দেয়। তারপর বাবুর কাছ থেকে যা শোনার শুনে নিয়ে সাইকেল টা ঠেলে বড় গেটের বাইরে গিয়ে সাইকেলে ওঠে।
সাতকাহনিয়া থেকে সাগর পুতুল। নদী বাঁধ ধরে। তীক্ষ্ণ তার নজর। তার যা কাজ সে করে সাইকেলে চেপেই। বাঁধের কোথায় গর্ত ; চিড় ; ফাটল সব তার নজরে। কোন গাছ মরল না ডাল শুকাল কিছুই তার নজর এড়ায়না। বাঁধে গোরু দেখেছে কি বাঁধ থেকেই মালিককে হাঁকডাক। ফেরে সে ই দুপুর পার করে।
কাজ খুব বাড়ে বর্ষার সময়। তখন নজর আরও কড়া। ইঁদুরের গর্ত ও নজরে রাখতে হয়। মাঝে মাঝে সাঁওতাল ছেলে গুলো গর্ত খুঁড়ে ইঁদুর বার করে যে। শিকড়বাঁধা মাঝি পাড়ার ছেলে গুলো কে কবার সে তাড়িয়েছে।
নদীতে জল বাড়ে। পঙ্কজ বাবু ডাক দেন। তাঁর সঙ্গে ছাতা নিয়ে নদী ধারে। জলের রঙ ; স্রোতের টান ; ফেনা দেখে সে ঠিক আন্দাজ করে কেমন বান আসতে চলেছে। , ঝোঁপ বেশী হয়েছে। চন্দ্রবোরা সাপ তো আছেই। তবু কোনো কোন দিন নামে। ফুল পেড়ে নিয়ে আসে।
তারপর গাঁয়ে ফিরে সেই ফুল নেবার জন্য কাড়াকাড়ি। কয় টা সে আলাদা করে রাখে। কোঁড়া পাড়ার মেয়ে বৌ গুলো খুব আবদার করে। আরও কত মেয়ে বৌ। এটা সে খুব উপভোগ করে।
মোতিচাচার অনেক গুলো ছাগল। সেই ছাগল গুলোর জন্যে কচি শ্যাওড়া ডাল নিয়ে আসে। ছাগলের খুব প্রিয়। আবার ঘরের খড়ের চালে ঈশান কোনে গুঁজবার জন্য মেয়ে বৌরা  চেয়ে নেয়। ১৩ বৈশাখ। ধর্মরাজের পুজো। কালুবীর এর থানে পুজো। বাগুড়ার কালুবীর এর থানে বিরাট এক মূর্তি আছে।
উলঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে। সে যে কোন ঠাকুর কে জানে। ওখানে একবার নামে। মেটে রা পুজো করে।
নতুন মেঘ দেখা দিচ্ছে। শ্যাওড়া ডাল গোঁজা থাকলে ঘরে বাজ পড়বে না। মানুষ বিশ্বাস করে।
গাঁয়ে ফিরে অফিসে গিয়ে বাবুকে সব কিছু বলে মোতি চাচার ছুটি। অফিসে র টেবিলে দুটি ডাল সমেত নাগকেশর ফুল নামিয়ে রাখে।
দিন প্রতিদিন। বাঁধে মোতিচাচা কে দেখা যাবেই। প্রতিটি অর্জুন ; শিমুল ; পলাশ ; বাবলা ; জিওল ; যজ্ঞডুমুর ; নিম ; বেল ; খেলকদম গাছকে সে চেনে। বিশাল শিমূলের কোটরে থাকা সবুজ টিয়া গুলো কেও সে বুঝি চেনে।
মোতিচাচা জানে এই বাঁধ অনেক দিনের পুরনো আর বাঁধের দুপাশে লাগানো এই গাছ গুলো ও। কিন্তু কত পুরনো সে সব জেনে কি লাভ। শুধু জানে ইংরেজ বাবুরা এই বাঁধ বানিয়েছিল। বানের জল আটকানো র জন্য। চাচা মনে মনে হাসে। সে জানে দু তিন বার বাঁধ ভেঙ্গেছে। বাঁধ দক্ষিণে সরে সরে গেছে। নদী খেয়ে নিয়েছে কত জমি।
সাতকাহনিয়া র শিমূল তলার ভাঙা বাঁধ ; কালীবাবুর ভাঙ্গা বাঁধ ; যজ্ঞ ডুমুর তলার ভাঙ্গা বাঁধ কতবার যে বাঁধ ভাঙ্গল আর কত কত জমি চলে গেল নদীর গর্ভে। বাঁধ যাতে না ভাঙ্গে সে চেষ্টা যে হয়নি তা নয়। খুঁটি পুঁতে ; পাথর ফেলে ; পাথর দিয়ে বাঁধিয়ে চেষ্টা হয়েছে। নদী সরে এসেছে অনেকটা। এদিকে। বর্ধমানের দিকে। ওপারে বিরাট চরা পড়ে গেছে। চাচা ভাবে আবার যদি তেমন বান আসে তবে আবার বাঁধ ভাঙ্গবে।
আর বাঁধ ভাঙ্গলেই বাবু আর কন্ট্রাক্টর দের লাভ। নদীর জল বাড়ল কি ; কনট্রাকটর দের আনাগোনা। রাতে ফিস্টি।
কখন ভাঙ্গে ;কখন ভাঙ্গে -
চাচা লেখাপড়া জানা লোক নয়। কিন্তু বাবু যদি জিজ্ঞেস করে কি মোতি কাজ কেমন হচ্ছে সে ঠিকঠাক বলে দেবে। জিভে তার ধার আছে। তাই অনেকে কিছুটা সমীহ করে।
সাতকাহনিয়া সেচ বিভাগের খালাসি মোতিচাচা। এরা নিজের কাজকে ভালো বেসে কাজ করত। শুধু চাকরি করা নয়। এসব মানুষ কমেই এলো। এদের কে মনে রাখার কোন দায় আমাদের নাই। এদের কে ভুলেছি ; উপেক্ষা করেছি আর তাই আজ এই দশা।
  একদিন সরকারি নিয়মে মোতিচাচার চাকরি থেকে বিদায় হয়ে গেল। আর আমি ডাকবাংলো যাবনা। বাঁধে যাবনা। একমাস চাচা ঘর থেকে বেরোয় ও না। কারো সাথে কথাও বলেনা।
তারপর একদিন বাঁধ ধারের লোকরা অবাক হয়ে দেখল আবার চাচা চলেছে তার সাইকেলে চেপে। পার হয়ে যাচ্ছে বাগুড়া ; জয়রামপুর ; মঙ্গলপুর;কাপালিপাড়া ;আকুলিয়া ; দেকুড়ি ;নপাড়া ;গোপালপুর ;মালিয়াড়া ;মালচা ;সাগরপুতুল।
  প্রতিদিন সকালবেলা বেরিয়ে ফেরা সেই দুপুর পার করে।
একদিন দেখি বাগুড়ার মোটা শিমূল টার গায়ে ঠেস দিয়ে বসে আছে।
দাঁড়ালাম। বললাম ' বসে আছো। উদাস চাউনি। ' ঘর যাও ' -
- হ্যাঁ যাই। যাব। ঘরে যেয়ে আর কি করব বাবা -
আমি বুঝি। ঘরে তো কেউ নাই। নিজের বলতে কেউ।
দুটো মেয়ে। কখনও কেমনো আসে। ঐ মেয়ে দের ছোট রেখে তাদের মা মরেছে।
বাউড়ী ঘরের এক মহিলা দুটো রেঁধে বেড়ে দেয়।
চাচা জানে সে নিয়ে গাঁ ঘরে কথা রটে। রটুক।
  আর আছে ছাগল গুলো। ওগুলো কে খুব ভালো বাসে।সব আলাদা আলাদা নাম আছে। ডাক দিলেই সাড়া দেয়।
আর ঘরের দুয়োরে বসে থাকে এক পাল সাদা ; কালো ; মেটে রঙের কুকুর। দু টি ভাতের আশায়। পরম বিশ্বাসে।
যেদিন মারা গেল সেদিন ও ওরাই চারপাশে।
----------- ----------- ----------- ----------- ----------- © প্রণব ভট্টাচার্য।