Sunday, 13 February 2022

আমাদের পাঁচ মাথার মোড়

।।বুঝলেন   আমাদেরও এক  পাঁচমাথার মোড় আছে।
 শ্যামবাজারে নয়। আবার শ্যামবাজারেই। 
 সে কি রকম! সে হচ্ছে এই যে ; এই এলাকার
 শ্যামবাজার মৌজাতেই সেই পাঁচ মাথার মোড়।  আমাদের অযোধ্যা - বনকাটি এলাকা। থানা - কাঁকসা। জেলা - পশ্চিম  বর্ধমান। 
 ও বাবা চিৎপুর না থাক  রবীন্দ্র সরণী ও আছে। ভাগ্যিস মনে পড়ল। 
 এলাকার প্রথম ;  নীচে মাটি র উপরে  মোরাম বোল্ডার আর উপরে ভালো মোরাম ; দুপাশে ইঁট দিয়ে বাঁধানো রাস্তা। এগারো মাইল 
 গুসকরা মোড় থেকে এ রাস্তা বেরিয়ে চলে এসেছে  সাতকাহনিয়া ডাকবাংলো পর্যন্ত।সেই সময়ের বর্দ্ধমান জিলা পরিষদের বানানো রাস্তা। শতবর্ষ হতে চলল  প্রায়।  একদিন এই রাস্তা দিয়ে দুটো বাস চলাচল করত। নরেন্দ্র বা রণেন্দ্র ট্রান্সপোর্ট। তারক বাবু ড্রাইভার। তারপর তাঁর ছাত্র নংরু ড্রাইভার)  ( অবণীভূষণ কুণ্ডু)। তিনি চালাতেন ' বৈদ্যনাথ ' বাস। ছিল ' গিল সার্ভিস '। এখন বালিখাদের ভারী ভারী ডাম্পার ; ট্রাক চলে।   
 এখানে এসে দাঁড়ান একটু। 
 চারপাশ টা চোখ বুলিয়ে নিন। 
 দেখুন। ছাতিম তলা। নীচে তার সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো বেঞ্চ। 
 বসতেই পারেন। বসুন। ভালো লাগবে। লোক চলাচল দেখুন। 
 উত্তর দিকে মুখ করে দেখুন ডান দিকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে রাস্তা। ডাঙ্গাল - বসুধা যাওয়ার রাস্তা।  পিচ ঢালা রাস্তা তৈরী হচ্ছে এখন।  খুব ভালো। শালবনের ভিতরে হাঁটবেন। যান না। 
ঐ রাস্তা ধরেই। রাস্তার দক্ষিণে শালবন। মহুয়া ; কেন্দু ; আর কাজুবাদামের দেখা মিলবে। আছে মোরাম চাতাল। সামান্য 
 খোয়াই। খারাপ লাগবেনা। শালফুলের গন্ধে আমোদিত বসন্তে - 
এই জঙ্গল টা শেষ হয়ে গিয়েছিল প্রায়। ঝাঁটি জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল। সে অনেক যুগ আগে শৈলেন সরকার নামে এক বনবিভাগের এক বীট অফিসার খুব যত্ন করে আবার এই জঙ্গল কে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন। লাগিয়েছিলেন কাজুবাদামের অনেক গাছ। শাল পিয়াল মুরগা এরা তো সব ছিল 
 একটা কি সুন্দর পিয়াল গাছ ছিল সাতকাহনিয়া যাবার পথের ধারে। তার পিয়াল খেয়েছি। না সেটাও  আর থাকল না। 
তখন সোনাঝুরি ; ইউক্যালিপটাস আসেনি। 
কি ছাতু ফুটত শাল পাতা পচে। কতরকমের ছাতু মানে মাসরুম। মাটির নীচে কুড়কুড়ে ছোট্ট ছোট্ট  গোল ছাতু। 
 কি তার স্বাদ। ঝাল ; ঝোল ঝোল তরকারি। 
না। এখন আর ফোটেনা। সব মাটি বিষ হয়ে গেছে। 
 উত্তরে যাবেন। যান। সামনেই ' তেপান্তর নাট্য গ্রাম' '। যদি এসেছেন আমার বলা র কিছু নেই। যদি না এসেছেন একবার ঘুরে আসুন। সামান্য কয়েক শো মিটার। নিশ্চয়ই ভালো লাগবে। অবাক ও লাগতে পারে যে এমন একটা নাটকের স্পেস আছে এখানে এই জঙ্গলে র ধারে। ভিতরে 
আবার সাতকাহনিয়া গ্রামের ভিতর দিয়ে নদী বাঁধ ধরে অজয় 
 কুলে চলে যান। অজয়কে দেখে আপনার কেমন লাগবে জানিনা। মরে যাচ্ছে। গেছে প্রায়। 
 সাতকাহনিয়ার  শতাব্দী প্রাচীন সেচ ডাকবাংলো টি দেখতে 
পারেন। খারাপ লাগবেনা। আগে ছিল খড়ের ছাউনী। 
এত বড় খড়ের ছাউনির ডাকবাংলো সারা দেশে ছিলনা প্রায়। 
  বাঁ দিকে ঘুরুন। রাস্তা চলে গেছে অযোধ্যা - বনকাটির হাটতলা হয়ে শ্যামবাজার অন্নপূর্ণা মন্দিরের পাশ দিয়ে একেবারে বনগ্রামের পাশ দিয়ে ইছাই ঘোষের দেউল পর্যন্ত। 
 এগারো মাইল বাসস্টপ থেকে বেরিয়ে এই পিচ ঢালা রাস্তা ; 
কোথাও ঢালাই অযোধ্যা গ্রামের পূর্ব মাথাকে ছুঁয়ে বাঁক নিয়ে 
এসেছে এই পাঁচ মাথার মোড়ে। 
 আমাদের পাঁচ মাথার মোড়ে কোন নেতাজী মূর্তি নেই। 
 আমাদের অনেকের খুব ইচ্ছে ছিল এখানে একটা ত্রিকোণ 
 আইল্যান্ড বানিয়ে একটা কিছু শিল্প কর্ম স্থাপনার। 
 প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনার প্রকল্পে ধরা নেই বলে ওঁরা ওঁদের 
 অক্ষমতা জানিয়েছিলেন। 
 অবশ্য রাতের উন্মত্ত গাড়ির ধাক্কায় তা টিঁকত কিনা তাও ভাববার। 
 দিনে এই জায়গার এক রূপ। পিছনেই অযোধ্যা হাই স্কুলের 
 গেট। পাশেই বিস্তৃত জায়গা নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়। পিছনে ই অযোধ্যা সমবায় সমিতির বিল্ডিং। পাশেই গ্রামপঞ্চায়েতের ভবন। 
 একদিন ছিল বিশাল আমবাগান। অযোধ্যা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের র জায়গায় ছিল একটি চারিদিকে ডাল পালা মেলা 
 বিশাল আমগাছ। গোড়া তার মাটি দিয়ে গোল করে বাঁধানো। 
 গোবর মাটি দিয়ে নিকানো গাছতলা।আলপনা দেওয়া। 
 আমরা তো ওখানেই বসেছি। চার দিকে মুখ করে চারটা 
 ক্লাস কেই বসানো যেত। বসানো হতও। " তোমারই গেহে পালিছ স্নেহে তুমি ধন্য ধন্য হে "। বা " আজি যত তারা তব আকাশে "। গাওয়া হত। শেখাতেন প্রধান শিক্ষক ; আমার মায়ের বাবা ;
 দাদু  ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায়। কয়েক জন মেয়ে খুব ভালো গাইত। 
 এই আমতলার নাম " কবিতলার গাছ। এর চারপাশ জুড়ে ঘিরে 
 টিকিট কাটিয়ে একবার বিখ্যাত গুমানী খাঁ এবং লম্বোদর চক্রবর্তী র বিখ্যাত জুটির কবিগানের আসর বসেছিল। সেই থেকে এই নাম। 
 প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ার জন্য সেই টাকা খরচ হয়েছিল। 
 একদিন এই ডাঙা পর্যন্ত বনকাটি র পিতলের রথ টেনে আনা 
 হত। একবেলার মেলা বসত। " রথ তলার ডাঙ্গা " - তাই নাম। 
 গ্রামের বাইরে নির্জন এই জায়গা বিদ্যালয় স্থাপনার জন্য 
 উপযুক্ত ভেবেই সেই ৮০-৮৫ বছর আগের মানুষ রা স্থির 
করেছিলেন। অযোধ্যা প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৯৪৪ সালে সরকারি অনুমোদন পায়। 
এই তো আমাদের পাঁচ মাথার মোড়। কবীন্দ্র রবীন্দ্র  তো আছেন ই আর ' তিন বাঁড়ুজ্জে '  বিভূতিভূষণ ; তারাশঙ্কর ;
 মাণিক এবং  জীবনানন্দের নামে এই সব গ্রামীন 
 রাস্তার নামকরণ করা যায় কি না এমন  ভাবনা একবার আমাদের মাথায় এসেছিল। গ্রাম পঞ্চায়েত এর বিবিধ  সিদ্ধান্ত খাতায় তা বোধহয় লিখিত ও হয়েছিল।           এই পাঁচ মাথার মোড়ে একটা আলোক 
 স্তম্ভ ( হাই মাস্ট বাতি স্তম্ভ)  বসানো কি যায়না! এগারোমাইল বাসস্ট্যান্ড 
 থেকে অযোধ্যা হাটতলা পর্যন্ত পথবাতি বসালে খুব ভালো হয়।  শ্যামবাজার স্বাস্থ্য কেন্দ্র তো আর যেভাবে চালু হবার কথা ( প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র হিসাবে)  তা তো আর কোন আমলেই হলনা। অথচ কি চমৎকার ছিল এর বিল্ডিং প্ল্যানিং। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা র প্ল্যান। একেবারে ইনডোর ; আউটডোর ব্যবস্থা। চমৎকার সব কোয়ার্টার। 
 বিশ্ব ব্যাংকের টাকায় ( IPP 4 স্কীমে) । সপ্তাহে দুদিন এখানে 
 হাটবার। অনেক মানুষ আসেন।  অন্ততঃ এই দুদিন একজন 
 ডাক্তার বাবু আসুন! 
 রাইটার্স বিল্ডিং পর্যন্ত বেশ কয়েকবার যাওয়া হয়েছে। 
 তৎকালীন বিধায়ক মাননীয় প্রয়াত কৃষ্ণচন্দ্র হালদারের সাথে 
 আমি গেছি। মাঝে বেশ কিছুদিন ডাক্তার বাবু নার্সরা আসতেন। সপ্তাহে তিন দিন হলেও। 
 এখন একজন ফার্মাসিস্ট বসেন। প্যারাসিটামল দেন। 
আর কে বা যায়। কেনই বা যাবে। সাধারণ মানুষের ধারণা 
 হাসপাতালের ওষুধে কোন কাজই হয়না। কয়েকজন 
ওষুধের দোকানদার বা গ্রামীণ ডাক্তার দের উপরে নির্ভর করেই চলছে প্রায় কুড়ি হাজার মানুষের জীবন। 
 এই হাসপাতালে র জন্য জমি দান করেছিলেন অযোধ্যার 
 মানুষ জন। কোয়ার্টার গুলি এখন ভগ্ন। ' ভূতেদের আখড়া '
 সব ভেঙে ফেলে সমস্ত জায়গাটায়  ফলের বাগান করা যায়। 
 ব্রাহ্মণগ্রাম বীজ খামার কে যুক্ত করে।কি হয় ওখানে! বোধ হয় বিরাট এক ' না '। 
চমৎকার করে সিমেন্ট পাচিঁল দেওয়া হয়েছে।তা না হয় হল। প্রায় ৬-৭ শো বিঘা জায়গা। কি উৎপন্ন হয় সেখানে! অপচয়! অথচ কি না ছিল সেখানে। 
 আধুনিক চাষের সব উপকরণ। এখনও পরিকল্পনা  
 করে অনেক কিছু ই করা যায়।      
 অনেক কিছুই করা যায়। শুধু শুধু পড়ে পড়ে পচছে দেখলে খারাপ লাগে। এই সব অপচয়ের জায়গা খুঁজে বের করা দরকার সরকারের। 
 তাই এ সব বলা। আশা করি প্রশাসন নজর দেবেন 

 একবার বেশি রাত্রে এখানে এসে বসুন। 
 এই পাঁচ মাথার মোড়ে। না। পঞ্চমুণ্ডি আসনে নয়। 
 ছাতিম তলের সেই বেঞ্চে। 
মাথার উপরে সপ্তপর্ণী আপনাকে প্রাণের আরাম দেবে কি না জানিনা। কিন্তু এক অনাস্বাদিত অনুভূতিতে আপনি জারিত হবেন 
 দেখবেন  কেমন এক আশ্চর্য নিস্তব্ধতা আপনাকে জড়িয়ে ধরেছে। 
 একটু গা ছম ছম করবে ই। 
 পাষাণচণ্ডী বাগানের শিয়াল গুলো ডাকছে। 
 হয়তো বা ' গুরুর বাঁধে ' জল খেতে এসেছে। 
 জামির তলার ডাঙ্গায় টাঁকসোনা দুটো পাখি ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে।আর লম্বা পায়ে এমাথা থেকে ওমাথা ছুটে যাচ্ছে। 
 রাত গভীর হচ্ছে। শালবাগানের উপরে  একটা তামাটে  চাঁদ 
 ঝুলে আছে এক অচেনা পৃথিবীর দিকে মুখ করে 
------------ ------------ ------------ ------------  আজ এখানেই শেষ করি

No comments:

Post a Comment