নরসিংহ বসু এবং তাঁর ধর্মমঙ্গল কাব্য ঃ সমাজচিত্রন। প্রণব ভট্টাচার্য
মঙ্গল কাব্য গুলির মধ্যে অনেকে ধর্মমঙ্গল কাব্য কে রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য বলেছেন।
যদিও আমরা অনেকে মনে করি অবশ্যই মধ্যমনি ধর্মমঙ্গল। কিন্তু অন্যান্য মঙ্গল কাব্য গুলির ভূমিকা মোটেই নগন্য নয়। বিশেষত
মনসা মঙ্গল, চণ্ডী মঙ্গল। এই তিন একত্রে এক মহাকাব্যিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে। তবে নিশ্চয়ই ধর্মমঙ্গল, অপর মঙ্গল কাব্য গুলির থেকে পৃথক।
অনেক কবিই ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনা করেছেন। ঘণরাম চক্রবর্তী কে শ্রেষ্ঠ বলা হয়। আমাদের আলোচ্য কবি নরসিংহ বসু এবং বিশিষ্টতায় অনন্য তাঁর কাব্য। এই নরসিংহ বসুর
পূর্ব পুরুষ দের আদি বাসস্থান ছিল এখনকার পশ্চিম বর্দ্ধমান জেলার কাঁকসা ব্লকের ' বসুধা ' গ্রামে। কবি ছিলেন রাজনগর এর রাজাদের উকিল, মুর্শিদাবাদ নবাব দরবারের প্রতিনিধি।
রাজনগরের রাজারা নিজেরা কর জমা দিতে যেতেন না। তা নিয়ে যেতেন বসু মহাশয়। স্বাভাবিক ভাবেই রাজনগর এবং
মুর্শিদাবাদ উভয় দরবারের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল।
তৎকালীন সময় এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি
যথেষ্ট অবহিত ছিলেন।
এই বসুধা থেকে বসবাস তুলে কবির পিতামহ মথুরা বসু চলে যান দক্ষিণ দামোদর এলাকার শাঁখারী গ্রামে।
আমরা কবির কথন ই শুনি
" শুন ভাই সভাজন করি নিবেদন।
যে রূপে ধর্মের গীত হইল রচন।।
বসুধা - মিরাস ভূমি ছিল পূর্বাপর।
মথুরা বসুজা কৈল শাঁখারি তে ঘর।।
সেই সময় বর্ধমানের অধিপতি ছিলেন মহারাজ কীর্তিচন্দ্র রায়। " অধিকারী সে দেশে কীর্তি চন্দ্র রায়। জগজনে যাহার যশের গুণ গায়।। "
আত্মপরিচয়ে ফিরেছেন কবি।
গৌতম গোত্রীয় দক্ষিণ রাঢ়ী য় কায়স্থ দশরথ বসু বংশের আদি পুরুষ। ১৬ শ পুরুষ মথুরা বসু।
জন্ম তাঁর ষোড়শ শতাব্দী তে। ষোড়শ - সপ্তদশ শতাব্দী তে বসুধা থেকে শাঁখারী তে আসেন।
মথুরা বসুর তিন পুত্র। ঘনশ্যাম ; রাধিকাবল্লভ ; রামকৃষ্ণ বসু।
ঘণশ্যামের পুত্র নরসিংহ বসু। (১৮ শ পুরুষ)।
১৭১৪ খ্রীঃ তে যিনি ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনা করেন।
এবং মৃন্ময়ী কালীমাতার প্রতিষ্ঠা করেন।
যে পূজা আজও শাঁখারী তে আজও অনুষ্ঠিত হয়।
ঘনশ্যাম এবং নবমল্লিকা র পুত্র নরসিংহ নিজেই বলেছেন
" পুরুষে পুরুষে মসীজীবী পূর্বাপর "
কবির খুব অল্প বয়সে ই পিতৃবিয়োগ হয়।
কিন্তু পিতামহী প্রবল শোকের মধ্যেও কবিকে পরম যত্নে মানুষ করেন। তাঁকে সংস্কৃত ; বাংলা ; আরবি ; ফারসি ; উড়িয়া প্রভৃতি ভাষায় শিক্ষিত করে তোলেন। আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগে কেমন করে তা সম্ভব হল - সে বড় সহজ কথা নয়।
এই শিক্ষার গুণে নানা জায়গায় রোজগারের সুযোগ পেলেও ফারসি ভাষায় দক্ষতার জন্য তিনি রাজনগর এর পাঠান রাজা বাহাদুর আসাদুল্লাহ খানের পক্ষে মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ র দরবারে উকিল হিসাবে নিযুক্ত হন এবং একাদিক্রমে আঠারো বৎসর তিনি এই পদে নিযুক্ত ছিলেন।
রাজকার্য এবং রাজ দরবার কে তিনি চিনেছিলেন গভীর ভাবে।
" বাঙ্গলায় বীরভূম বিখ্যাত অবণী। শ্রী আসফুল্লা খান রাজা শিরোমণি "।।
" কৃপা করি নৃপমণি রাখিল চাকর। ওকালতি একক্রমে আঠারো বৎসর "।।
পরে আরও কিছুদিন এই রাজবংশের সাথে তাঁর যোগ ছিল।
নরসিংহ বসুর ধর্মমঙ্গল ঃ সমাজ চিত্রন তৃতীয় পর্ব
রাজা মানেই রাজকর বা রাজস্ব।
মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে খুবই ' বুঝে নেওয়া লোক '।
রাজনগর এর পাঠান রাজা আসাদুল্লাহ খানের কাছে খবর পাঠানো হল যে তাঁর সাত লক্ষ টাকা খাজনা বাকী। অবিলম্বে মেটাও।
রাজার মতে কোন বাকী নাই। সময়কাল টাকে মাথায় রাখতে হবে। নিদারুণ অনাবৃষ্টি। চাষই হয়নি। প্রজারা দেবে কোথা থেকে। রাজা প্রজা হিতৈষী।
একে তো নিজেদের মর্যাদা বোধে এঁরা কখনও মুর্শিদাবাদ দরবারে রাজস্ব বা নজরানা নিয়ে যাননা। যান তাঁদের প্রতিনিধি। প্রতিনিধি নরসিংহ বসু।
রাজনগর জানাল যা বকেয়া বলা হচ্ছে তা কিছুতেই নয়।
ঠিক করলেন মেটাবেন না কর।
নবাব ছাড়বার পাত্র নন।
গোলমালের আশংকা করলেন নরসিংহ।
না। না। বড়ো গোলযোগ দেখা দিতে আ। রাজাকে বোঝালেন ।রাজা বড় জোর এক লক্ষ টাকা দিতে রাজি হলেন। বেশ দেখা যাক। নরসিংহ ভাবলেন।
রাজা নরসিংহকে জোড়া ; পাগড়ি ; ইত্যাদি রাজকীয় পোষাক দিলেন। আবার যেতে হবে মুর্শিদাবাদ।
অনেক দিন বাস্তুগৃহে যাওয়া হয়নি। অধিকাংশ সময় তো কাটে নবাব দরবারে মুর্শিদাবাদে।
ঠিক করলেন একবার শাঁখারী ঘুরে যাবেন।
পালকি চলল শাঁখারী অভিমুখে। পথে পড়ল আউসগ্রাম।
কোন পথে গেলেন? পথ তো এই ই। ইলামবাজার থেকে অজয় পার হয়ে বসুধা ভায়া আদুরিয়া ; ভাতকুণ্ডা আউসগ্রাম।
এইখানে আমার মনে প্রশ্ন জাগে ' বসুধা ' র কথা কি একবারও মনে পড়েনি নরসিংহের। বসুধা তাঁর দাদু ত্যাগ করে গিয়েছিলেন। কেমন ছিল সে পিতৃপুরুষ এর গ্রাম। বা পোড়ো বাস্তুভিটা। না তার কোন কথা নেই। পথযাত্রার বিবরণ নাই।
ঝড় বৃষ্টি র জন্য আউসগ্রামে রাত্রিযাপন। পরের দিন ঝিকিমারি গ্রামে তাঁর যশোদা পিসির বাড়িতে স্নান পূজা সারলেন। পিসির ছেলে নারায়ণ তাঁদের উপযুক্ত আপ্যায়ন করলেন।
তারপর ওখান থেকে দামোদরের কাছে জুঝুটি গ্রামের পথে আবার জল বৃষ্টি পেলেন। গ্রামের পথে কাদা।
তবে এদিকে ঐ সময় জুঝুটি গ্রামে এক খেজুর গাছের তলায়
খুব পরিপাটি করে ধর্মের পুজা হচ্ছি
"জুঝুটি গ্রামে খেজুর গাছ তলায় পরিপাটি করে ধর্মরাজ পুজো।
পালকি দূরে রেখে ; পায়ে হেঁটে ধর্মরাজ পুজোর ওখানে গেলেন নরসিংহ।ভক্তি ভরে দেখতে লাগলেন।
" নয়ন ভরিয়া তথা দেখে মায়াধর।
খেজুর তলায় উপস্থিত তারপর।।
কতদূরে লোকজন রাখিয়া বাহন।
একেলা গেলাম ধর্ম করিতে দর্শন।।
সেই সময় ' অপূর্ব সন্ন্যাসী এক আসি উপস্থিত '।
আশীর্বাদ দিয়া কন গাও কিছু গীত।।
কবি সন্ন্যাসী কে দুহাত জোড় করে প্রণাম করে উঠে দেখেন
সন্ন্যাসী অদৃশ্য।
এই রকম একটা অলৌকিক ঘটনায় কবি স্বাভাবিক ভাবেই কিছুটা বিহ্বল। নানা চিন্তা মনে। যাই হোক শাঁখারী র বাড়িতে পৌঁছালেন। কিন্তু মনে তার সেই একই চিন্তা। মনকে আলোড়িত করে। আত্মীয় বন্ধুদের সাথে আলোচনা করেন।
বাড়িতে দুদিন থাকলেন। তারপর আবার মুর্শিদাবাদ এর পথে।
যাক। নবাব দরবারে ঐ এক লক্ষ টাকাতেই মিটমাট হয়ে গেল। কবির জয় হল।
কিন্তু মনে সবসময় ধর্মরাজের গীতের কথা। মনে উথলে ওঠে গীত। তাই অবশেষে কবি হাত দিলেন তাঁর ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনায়।
কাব্য রচনার সাল তারিখ বলেছেন সেই সময়ের কাব্য রীতি মেনেই
" শশ শশী পিঠে ঋতু ভুবনেতে রস।
কবিত্ব আরম্ভ কর্কটের দিনে দশ।।
সঙ্কেত কে বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় শশী মানে চাঁদ বা ১ ; ঋতু =৬ অর্থাৎ একের পিঠে ছয় ; তারপর ভুবন = ৩ এবং রস =৬
দাঁড়াল ১৬৩৬ (শকাব্দ)। আর কর্কট মাস মানে ভাদ্র মাস।
কর্কটের দিনে দশ। ১০ ই ভাদ্র।
১৬৩৬ শকাব্দের ১০ ই ভাদ্র।
এই বিশ্লেষণ ডক্টর সুকুমার মাইতি র।
ডঃ সুকুমার সেন এবং ঐতিহাসিক রজতকান্ত রায় ও কবির কাব্য রচনা র কাল বলেছেন ১৭১৪ খ্রীঃ।
এই ভাবে কাব্যরচনা র কাজ একদিন পূর্ণাঙ্গ রূপ পেল।
' দিনে দরবার করি রাতে রচি গীত।
ধর্মের কৃপায় পূর্ণ হইত সঙ্গীত "।।
---------
বসু মশাই এর ভয় কিন্তু যায়না।
বসুধা ছেড়ে তাঁর পিতামহ বর্ধমানের নিকটবর্তী দক্ষিণ দামোদর এলাকার শাঁখারী গ্রামে বসতি স্থাপন করেছেন।
বর্ধমান রাজ কীর্তিচন্দ্র। তাঁর কাছাকাছি থাকা যাবে।
কখন কোন সুযোগ আসে বলা যায়না।
আবার সেখানে দেবী অষ্টভুজা শঙ্করী। তাঁর পদছায়ায় থাকা যাবে। বসুধার চেয়ে উন্নত গ্রাম।
নরসিংহ তাঁর ধর্মমঙ্গল কাব্য লিখছেন ১৭১৪ সাল নাগাদ।
এলাকায় সদগোপ প্রাধান্য। তাঁরা নিজেদের ইছাইঘোষ এর বংশধর বলেন। এখানের সদগোপ দের মধ্যে একধরনের আভিজাত্য এবং তেজ আছে। সেটা এখনও লক্ষ্য করা যায়।
চেহারা বা গাত্রবর্ণ বৈশিষ্ট্য পূর্ণ।
সেই সদগোপ প্রাধান্য কে কবি ভয় করছেন। তার ইঙ্গিত তাঁর কাব্যে রয়েছে।
যেমন তিনি তুলনা করছেন
" ইছাই বসিল পাটে না জানি কখন কাটে
পরিবার সহিত আমাকে।
যদি বা দেশেতে থাকি কার বাপে মোকে রাখি
গোয়ালাতে যদি প্রাণ লয়।।
করি এই অনুমান ছেড়ে ঘর ধনধান
রাজ্যপাট রতন মন্দির।
পরিজন সঙ্গে নিয়া দেশভূম পরে দিয়া
পলাইলা পরাণে অস্থির।।
ইছাই এর ভয়ে রাজ্যপাট ছেড়ে কর্ণসেন গৌড় দেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
আর এই লেখার পর ই তিনি লিখছেন
বসুধা - মিরাস ছাড়ি শাঁখারি তে ঘরবাড়ি
করিলেন মথুরা বসুজা।
সত্যবাদী সদাচার সদাই সাপক্ষ যার
আপনি শঙ্করী অষ্টভুজা
কখন ; কতকাল আগে ইছাই - কর্ণসেন এর ঘটনা।
তবু যেন কবি কোথাও মিল পাচ্ছেন।
হতে পারে ইছাই এর মতো কোন ব্যক্তি র ভয়।
অন্যান্য কারণ তো রয়েছেই।
কিন্তু নরসিংহ যখন তাঁর কাব্য লেখায় মন দিয়েছেন তিনি তো তখন রাজনগর এর রাজা আসাদুল্লাহ খানের রাজকর্মচারী।
স্বাভাবিক প্রভাবশালী। মুর্শিদাবাদেই তাঁর বেশী সময় কাটে।
নিজেই বলেছেন বংশানুক্রমিক ভাবে তাঁরা মসীজীবী।
কে জানে তাঁর ই কোন পূর্বপুরুষ ই ছিলেন বা কোন কায়স্থ ই গৌড়েশ্বর কে ইছাই এর খাজনা বাকী র হিসাব দিয়েছিলেন।
কর প্রদান কে কেন্দ্র করেই তো লড়াই।
ইছাই স্বতন্তর রাজা হয়েছেন।
গৌড়েশ্বর কে কর দেওয়া বন্ধ করেছেন। অধীনতা অস্বীকার করেছেন।
নরসিংহ এর কাছ থেকে আমরা পেয়েছি বিরাট এক ধর্মমঙ্গল কাব্য। কিন্তু তিনি ও দেবী পূজক।
তাঁর ধর্মমঙ্গল কাব্য সহজ সরল। অকারণ কবি সুলভ কাব্য ভারাক্রান্ত নয়।
আমার আক্ষেপ তাঁর কাছ থেকে আমরা সেই সময়ের রাজনগর ; মুর্শিদাবাদ বা এই এলাকার এক চমৎকার ঐতিহাসিক বিবরণী পেতে পারতাম।
এলাকা তাঁর পরিচিত। রাজকার্য ; হিসাব নিকাশ দক্ষ।
মুর্শিদাবাদে মুর্শিদকুলী র রাজত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞাত।
সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর পরিচিত জনেরা আছেন।
তাঁদের মাধ্যমে ও নানা খবর তাঁর কাছে থাকা খুব স্বাভাবিক।
রাজনগর থেকে মুর্শিদাবাদ যাতায়াত করেন নিয়মিত।
রাজনগরের প্রতিনিধি হিসাবেই তিনি ' হুজুরে চালান ' অর্থাৎ রাজকর জমা দেন। রাজনগর এর রাজাদের অত্যন্ত বিশ্বস্ত।
দীর্ঘ আঠারো বছর সেখানে কাজ করেছেন।
আসাদুল্লাহ বা বর্দ্ধমান রাজ কীর্তিচাঁদের গুণগান করেই ছেড়ে দিয়েছেন। আবার মুর্শিদকুলী যে রাজ কর আদায়ের ব্যপারে যথেষ্ট কড়া - এটুকু ই মাত্র।
পেতে আমরা পারতাম কবি আপনার কাছ থেকে এক অত্যন্ত
দামী ঐতিহাসিক বিবরণী। যা হতে পারত তাঁর ধর্মমঙ্গল কাব্যের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।
অবশ্য যা পেয়েছি তার মূল্যই বা কম কি।
---------------- ---------------- ---------------- © প্রণব ভট্টাচার্য। আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চাকারী
** চণ্ডীদাস পত্রিকার শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত
গ্রন্থ সহায়তা। নরসিংহ বসুর ধর্মমঙ্গল ঃ তারাপদ বসু।
নরসিংহ বসুর ধর্মমঙ্গল ঃ ডক্টর সুকুমার মাইতি।
লেখকের নিজের লেখা এই বিষয়ক নান প্রবন্ধ।
বর্ধমান ঃ ইতিহাস ও সংস্কৃতি। যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী
No comments:
Post a Comment