।। গোপভূম ঃ কাঁকসা রাজবংশ ঃ কথা ও কাহিনী।। ১ ম পাতা। ------------ প্রণব ভট্টাচার্য
প্রাচীণ ' গোপভূম '। অজয় দামোদর উপত্যকা ভূমির বিস্তীর্ন
ভূভাগ গোপভূম নামেই প্রাচীণকাল থেকেই পরিচিত।
প্রাচীণ। কিন্তু কত প্রাচীণ এই নাম। অন্তত বাঙ্গলার পাল - সেন রাজাদের সময়কাল থেকে। না কি তার ও আগে।
পাল - সেন যুগে রাঢ় বঙ্গে ' দ্বাদশ ভূমের ' উল্লেখ পাওয়া যায়।
এই দ্বাদশ ভূম হচ্ছে ১) বীরভূম ২) সেনভূম ৩) শিখরভূম
৪) গোপভূম ৫) ব্রাহ্মণ ভূম ৬) মানভূম ৭) বরাভূম ৮) ধলভূম
৯) সিংভূম ১০) তূণভূম ১১) মল্লভূম ( মাল ভূম) ১২) ভঞ্জ ভূম।
এই সব ভূমের সামন্ত বা ভৌমিক রাজারা প্রায় স্বাধীন ভাবেই নিজ নিজ এলাকা শাসন করতেন। কেন্দ্রীয় পাল বা সেন রাজাদের কর প্রদানকারী অধীনস্থ সামন্ত। পাল রাজাদের আমলে এঁদের কে বা এঁদের মতো অন্যান্য ভৌমিক রাজাদের
' অনন্ত সামন্তচক্র ' বলা হয়েছে। আবার এঁদের উপরেই অনেকাংশে নির্ভর করতে হত কেন্দ্রীয় শাসক দের।
উত্তরে র কৈবর্ত বিদ্রোহের সময় রামপাল কে এই সামন্তবর্গ
সহায়তা করেছিলেন। পশ্চিমের এই সীমান্ত এলাকা প্রহরার
ব্যবস্থা এঁরাই করতেন, নিজেদের শক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী।
কিন্তু তেমন যুদ্ধ প্রস্তুতি এঁদের ছিল বলে মনে হয়না। রাজেন্দ্র চোল বা ধঙ্গদেব বা লক্ষ্মীকর্ণ রাঢ়দেশ জয় করে আরও উত্তরে
অনেক টা অগ্রসর হয়েছিলেন।
রাজেন্দ্র চোল এর তিরুমালাই গিরিলিপি তেই উত্তররাঢ় এবং দক্ষিণ রাঢ়ের উল্লেখ রয়েছে। তিনি রাঢ় দেশ জয় করেছিলেন।
ধঙ্গদেব রাঢ়াধিপতিকে পরাজিত এবং নিহত করে রাঢ়ের মহিষী সহ রমনী দের বন্দী করে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর খর্জুরবাহক লিপি তে তার উল্লেখ আছে। তবে চোল বা
ধঙ্গদেবের লিপিতে রাঢ়ের অধিপতি কে ছিলেন তার কোন উল্লেখ নাই। উল্লেখ আছে দক্ষিণ রাঢ়ের রাজা রণশূর বা এক
ধর্মপালের। এই ধর্মপাল কিন্তু গৌড়াধিপতি ধর্মপাল নন।
লক্ষ্মীকর্ণ বীরভূম পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। পরে তাঁর সাথে
গৌড়াধিপতি র সন্ধি হয়। এই সন্ধির মধ্যস্থতা করেছিলেন
অতীশ দীপংকর।
ইছাই ঘোষের সময়কাল নিয়ে নানা মতভেদ আছে। বা তাঁর পূর্ব পুরুষ দের। বাঙ্গলা দেশের রামগঞ্জ নামক স্থানে প্রাপ্ত
তাম্রশাসনের শুরুতে ই লিখিত " বভুব রাঢ়াধীপ লব্ধজন্মা "
তিনি রাঢ়াধিপ ; মহামাণ্ডলিক। তিনি ত্রিষষ্টিগড়ের অধিপতি।
এই " ত্রিষষ্টিগড় " কি ছোট বড় মিলিয়ে ৬৩ টি গড়!
তাঁর অধীনস্হ রাজকর্মচারী দের নাম দেখে মনে হয় তিনি
রাঢ়দেশর এক জন ক্ষমতাশালী মহামাণ্ডলিক। এই মহামাণ্ডলিক উপাধি পাল রাজাদের আমলে প্রদান করা হত।
তিনি নিশ্চিত ভাবেই রাজেন্দ্র চোল বা ধঙ্গদেবের আক্রমণের পূর্ব বর্তী বংশের ব্যক্তি। সম্ভাবনা বেশী রাজা দেবপালের সময়কালের মানুষ তিনি।
আবার এক প্রশ্ন কোথায় রাঢ়দেশ আর কোথায় রামগঞ্জ!
সেখানে কিভাবে গেল তাঁর প্রচারিত তাম্রশাসন?
ইছাই ছিলেন তান্ত্রিক। তন্ত্রের মহা পীঠস্থান কামাখ্যা যাওয়ার পথে তিনি এই তাম্রশাসন প্রচার করেছিলেন এমন অনুমান
খুব অসঙ্গত নয় বোধহয়।
৬ ষষ্ঠ শতকের এক রাজা গোপচন্দ্রের উল্লেখ আমরা পাই
গলসীর নিকট বর্তী মল্লসারুল গ্রামে প্রাপ্ত তাম্রলিপি থেকে।
সেটি মল্ল সারুল লিপি হিসাবেই বিখ্যাত। রাজা গোপচন্দ্রের
অধীনস্থ মহাসামন্ত বিজয় সেন স্বাধীন ভাবেই এই এলাকা য়
রাজত্ব করতেন। এক ব্রাহ্মন নির্বোক শর্মাকে জমি ক্রয় করে
তাঁকে দান করা হচ্ছে।
এই গোপচন্দ্রের নামের সাথে গোপভূম এর নামের বেশ সাযুজ্য রয়েছে।
অজয় দামোদর উপত্যকা ভূমির বিস্তৃত চারণভূমি র জন্য
পশুপালক ; কৃষিজীবি ; গোপ বা সদগোপ দের বসতির
প্রাধান্যের জন্য এলাকার নাম " গোপ ভূম "। এমন মত খুবই প্রচলিত। সদগোপ রা বাঙ্গলার অন্যতম প্রধান প্রাচীন জাত।
কর্ম অনুযায়ী জাতের পরিচয়। গোপ দের সাথে সদগোপ দের
একটা সম্পর্ক অবশ্যই ছিল। গোপ অর্থে গোয়ালা। সদগোপ্ রা মূলত কৃষি কর্মে দক্ষ। এবং তাঁরা কৃষিজীবি। উদ্বৃত্ত ফসল বা শস্য তাঁরা বিক্রয় ও করেন। অনেকে নিজেদের বর্ণ হিসাবে
বৈশ্য বলেন। সদগোপ দের মধ্যে কৌলীন্য প্রথা বা থাক ; ঘর এসব চালু করেছিলেন বিখ্যাত সদগোপ রাজা মহেন্দ্র।
অমরারগড়ে ছিল যাঁর রাজধানী।
স্থানীয় গোপদের পাশাপাশি বাইরে থেকেও অনেক এই পেশার
মানুষ এখানে এসে বসবাস স্থাপন করেন। পর্যাপ্ত চারণভূমি র
লোভেই তাঁরা এখানে আসেন। এঁদের ও তাই কয়েকটি থাক।
স্থানীয় রা পশুপালনাদি সহ চাষাবাদ ও করেন। কিন্তু আহীর গোপ বা পল্লব গোপেরা সাধারণত কৃষি কর্মে যুক্ত নন।
সম্ভবত বহিরাগত দের সাথে একদল গোপেদের মিলন মিশ্রণ
থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে সদগোপ রা পৃথক হয়ে যান। রাজা ভল্লুপাদ থেকে রাজা মহেন্দ্র কে সদগোপ রা নিজেদের নায়ক বলেই মনে করেন।
অপর দিকে গোপ রা তথা কিছু সদগোপ রা ও ইছাই ঘোষ কে
তাঁদের নায়ক হিরো বলেই মনে করেন।
রাজা ভল্লুপাদের কথা কাহিনী আলাদা করে বলা দরকার যদিও বহুশ্রুত।
এই ভল্লুপাদ রাজার ( ভালকী যাঁর রাজধানী ছিল) পুত্র
গোপাল। গোপালের পুত্র শতক্রতু। শতক্রতু পুত্র মহেন্দ্র এবং
অমরেন্দ্র। তারপর এগারো জনের নাম কীটদষ্ট পুঁথি র জন্য
না পাওয়া যাওয়ায় শেষ রাজা বৈদ্যনাথ। তিনিই বহিরাক্রমনের র জন্য রাজ্যচ্যুত হন। এবং বংশের অন্যান্য রা
নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েন।
ভালকী বংশ জাতরা " রায় " পদবী গ্রহন করেন।
রাজা মহেন্দ্রের রাজধানী ছিল অমরারগড়। তাঁর স্ত্রীর নামে এই নাম। অমরাবতী মল্ল রাজ বংশের মেয়ে ছিলেন।
রাজা মহেন্দ্র ছিলেন নানা গূণবিশিষ্ট একজন প্রকৃত রাজা।
পুকুর দিঘি খণন সহ নানা জনহিতকর কাজ তিনি করেছিলেন। আজকের সমগ্র এলাকা দেখলে তা প্রতীয়মান হবে। এই জলাশয়। পুকুর দিঘি।
পরবর্তী প্রজন্মে শক্তিশালী রাজপুরুষ এর কথা মাথায় রেখে
রাজপুতনা বা পশ্চিম দেশ থেকে তিনি তাঁর দুই জামাতাকে
আনয়ন করেছিলেন। বড়মেয়ে যমুনার সাথে বিবাহ হয়
শিবাদিত্য এর। আর কালিন্দি র সাথে বিবাহ হয় প্রতাপাদিত্যর। উভয় জামাতাই বহিরাগত। রাজপুত রক্ত আমদানি করার জন্যই তাঁর এই পরিকল্পনা। তিনি এই অনুভব করেছিলেন রাজ্য শাসনে শৌর্য বীর্য সম্পন্ন শক্তি শালী মানুষ চাই।
সিহুড় বা কাঁকসা রাজবংশের সাথে রাজা ভল্লুপাদের প্রত্যক্ষ যোগ নাই। তাঁরা রাজা মহেন্দ্রর দুই জামাতা। জামাতা ভ্রাতারা
বা তাঁদের বংশের সন্তানেরা নিজেদের কুমার বা কুঙার বলে
পরিচয় দেন।
আগেই যাঁর পরিচয় দেওয়া হয়েছে তিনি
ভল্লুপাদ পুত্র গোপাল। যাঁর নামে নাম হয়েছে " গোপভূম "।
এমন মত ও যথেষ্ট মনোযোগ এর দাবী করে।
এবং সম্ভাবনা প্রবল বলেই আমরা মনে করি।
রাজা মহেন্দ্র র আরাধ্যা দেবী শিবাক্ষ্যা। দশভুজা এই প্রস্তর
মূর্তি রাজা মহেন্দ্র খাজুরডিহি র এক বাড়ি থেকে আনয়ন করেন। শিবাক্ষ্যা সমগ্র গ্রামের গ্রামদেবী। এই শিবাক্ষ্যা দেবীর মন্দিরে যে পুঁথি ছিল( যা এখন আর দেখা যাবেনা। হয় বিনষ্ট নয়তো লুণ্ঠিত) সেখানে যে গাথাবলী ছিল সেখানের তথ্যেই
স্বাভাবিক ভাবেই অনেকে বিশ্বাস স্থাপন করেন।
------------ ------------ ------------ ------------ ১ পাতা শেষ।
আগামীকাল বা পরশু পরবর্তী অংশ টি দেব।
অনেক পুরনো লেখা।
বিস্তৃত আছে আমার এলেমবাজার নিলামবাজার ইলামবাজার বই টি তে। প্রকাশিত ২০২৩ কলিকাতা বই মেলা
No comments:
Post a Comment