Saturday, 13 March 2021

বসুধা থেকে মৌখিরা কালিকাপুর। কত ইতিহাস

বসুধা। 
মধুক্ষরা নাম। 
এই বসুধায় ছিল ধর্মমঙ্গল কাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি 
নরসিংহ বসুর পূর্বপুরুষ দের আদি বাসস্থান। 
 নরসিংহ এর পিতামহ মথুরা বসু বসুধা ত্যাগ করে 
 পূর্ব বর্ধমান এর দক্ষিণ দামোদর এলাকার শাঁখারী 
 গ্রামে চলে যান। সেখানেই স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে থাকেন। 
 " বসুধা - মিরাস ছাড়ি   শাঁখারিতে ঘরবাড়ি 
     করিলেন মথুরা বসুজা। 
  সত্যবাদী সদাচার   সদাই সাপক্ষ যার 
    আপনি শঙ্করী অষ্টভুজা।। 
আবার লিখছেন নরসিংহ 
 ' দিনে দরবার করি রাতে রচি গীত। 
 ধর্মের কৃপায় পূর্ণ হইত সঙ্গীত।। 
 অনাদ্যের মায়া কিছু বুঝা নাহি যায়। 
 ধর্মের আজ্ঞায় বসু নরসিংহ গায়।। 

 দিনে দরবার করি। 
 বীরভূমের পাঠান রাজা আসাদুল্লাহ খানের পক্ষে 
 কবি নরসিংহ বসু আঠারো বছর হিসাবরক্ষক তথা ওকালতির কাজ করতেন। 
 মুর্শিদাবাদ নবাব দরবারে নগরের রাজার প্রতিনিধি হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। 
 ঐতিহাসিক রজতকান্ত রায় কবির কাব্য  রচনাকাল উল্লেখ করেছেন ১৭৬৪ খ্রিঃ.

 আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি বসুধা গ্রামে কোথায় ছিল সেই ' বসুধাম '। বসু পরিবারের আদি নিবাস। 
 বসুধা খুবই বিস্তৃত। 
 বৃদ্ধনদীর দক্ষিণে যে বসুধা। আজকের ভাণ্ডারী পাড়া বা আরও পশ্চিমে যার রূপাই চণ্ডী তলা ;
 রূপুটে পাড়া সেখানে যে অতি প্রাচীন ভগ্ন শিব মন্দির  বা পাশেই ধর্মরাজ তলা 
 সেখানেই কি ছিল বসু পরিবারের আদি বাসস্থান? 
  সম্ভবতঃ। 
 খুঁজে যাই  তবু -

এই বসুধা কোথায়? 
 পশ্চিম বর্ধমান। থানা কাঁকসা। পানাগড় মোরগ্রাম হাইওয়ে র  উপরে ই বসুধা। বসুধা পার হয়েই অজয় সেতু। ওপারে ইলামবাজার।

Monday, 8 March 2021

ও পলাশ! পলাশ রে

বুঝলি পলাশ 
এখন তো তোরই দিন বটে 
আর কদিন পরে রঙের পরব। 
কত গলায় যে ঝুলবি। আহা 
ফাগুন লেগেছে বনে বনে 
আগুন আগুন রঙের আগুন 
যাক সবাই বনে যাক। খোয়াই এর ভিতরে ভিতরে কোপাই এর ধারে যাক 
পলাশথলী তে যাক। বিহারীনাথ হয়ে হালদা পাহাড়ের রাঢ়মাটির দেশে যাক

বুঝলি পলাশ 
আমি একটু অন্য কথা বলি 
তোকে দেখলে আমার মনেপড়ে পলাশ পাতার ঠোলায় আঁকুড়  বেরুনো  বুটকলাই ভেজা পুরুলিয়া বা দুশো বছর আগের 
আমাদের এই জঙ্গলমহলের শাল পলাশের বন - যার নামই হয়ে গিয়েছিল সেন পাহাড়ি র লা - মহল। মানে লাক্ষা মহল। 
এত লাক্ষা গুটি পোকার বাস চাষ ঐ পলাশ বনে বনে । ইলামবাজারের ইংরেজ কোম্পানী র রমরমা গালার ব্যবসা। 
এখান থেকেই মণ মণ গালা যায় কুঠি তে। কত মানুষের জীবিকা ছিল। খেয়ে পরে বাঁচত গরীব মানুষেরা । বেশির ভাগ মানুষ তো বনবাসী সাঁওতাল আদিবাসী।  তারাই বনে বনে সংগ্রহ করত গালা কাঠি গুলো। 
তাদের কাছ থেকে কিনে নিত স্থানীয় বাবুরা। তারপর তারা বেচত ইংরেজ কুঠি তে। তাতেই  এত বড়লোক। কলকাতায় থেকেছে। আরও রোজগার। আরও। আরও। 
আমাদের এই বনকাটি র মুখুজ্জে বাবুরা 
বিরাট প্রাসাদ বানিয়েছে। মন্দির তৈরী করিয়েছে। পিতলের রথ বানিয়েছে। 
কলকাতা থেকে মিস্ত্রি এনে। খোদাই কার এনে। দেখার মত বটে সে সব ছবি। 
কত মানুষ দেখে গেছে। 
আর কত দেখতে আসছে এখন। 
বুঝলি পলাশ।
ক টা দিন থাকিস।

ভোলানাথ দাদু আর ডেলা দিদি

আর এক ভোলানাথ ও ডেলা দিদির কথা
-----------------------------------------------------------
কত যে কথা। কে আর মনে রাখে।
নাম ভোলানাথ। বেশ লম্বা চওড়া চেহারা। কিছুটা পৃথুল। ফর্সা রঙ। প্রকৃত ই সুপুরুষ।
বাড়ি পার্শ্ববর্তী এলাকার আদুরিয়া - অমরপুর।
দক্ষ কাঠমিস্ত্রি এবং রাজমিস্ত্রি ও। কাজের সূত্রে অযোধ্যা - বনকাটি তে প্রায়ই আসতে হয়।
একদিন নজরে পড়ল দলুই পাড়ার এক সুন্দরী মেয়েকে। মুখশ্রী সুন্দর। কিছুটা গোলাকৃতি। খুবই ফর্সা। ভালো না লেগে উপায় নাই। লাগলোও।ডাক নাম ডেলা। ভালো নাম তো আছেই। সুধাময়ী।
সম্পর্ক গড়ে উঠল। ভালোলাগা ভালোবাসায় পৌঁছালো।
পড়ে থাকল জাত কুলের ব্যবধানের কথা।
সে সম্পর্ক পরিণতি পেল বিবাহে।
  সে বড় সহজ কথা নয় সেই সময়ে।
ভোলানাথ আর দলুই ঘরের মেয়ে সুধাবালা ধাত্রী র বিয়ে কি আর সমাজ মেনে নেয়। নিলনা। নেবেনা যে তা ভালোই জানত ভোলানাথ। কিন্তু তাদের প্রেম কোন বাধা মানেনি। জয়ী হল প্রেম  আর জাতিচ্যুত করল
তাদের সূত্রধর সমাজ।
আর কখনওই আদুরিয়া অমরপুর এলাকায় ফিরে যায়নি ভোলানাথ। তার আত্মীয় স্বজন রা আছে। হ্যাঁ ; এখনও আছে। জয়দেব কেন্দুলী র কাছে র বিখ্যাত গ্রাম জনুবাজারে তার ভাগনে রা আছে। সেখানেই বিয়ে হয়েছিল তার বোনের। রবি ; নন্দ তার ভাগনে।
তারা মাঝে মাঝে অযোধ্যা গ্রামে আসে। দলুই বাড়ির তাদের মামার বর্তমান বংশধর দের সাথে যোগাযোগ রাখে। বর্তমান বংশধর বলতে - ভোলানাথ সুধাময়ী র কোন পুত্রসন্তান ছিলনা। ছিল এক মেয়ে। নাম তার ভবানী। সেই ভবানীর ও গ্রামেই বিয়ে হয়েছিল।স্বামী র নাম - সিদ্ধেশ্বর। 
তাঁদের আবার তিন মেয়ে। বড় হরিদাসী ; আমাদের হারা দিদি র সাথে ই কথা বলছিলাম। মেজ বোন তারাদাসী মারা গেছে। আর ছোট লীলা আছে। কথা বলার সময় হারাদির ছেলে নাড়ু দলুই সাথে ছিল। তার জীবন ও বিষাদময়। তাঁর স্ত্রী ললিতা কেন যে আত্মহত্যা করে নাড়ুকে একা করে দিয়ে চলে  গেল। দুই মেয়েকে বড় করে তোলা। তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করা।ছোটটির সম্বন্ধ চলছে।
মেয়েরা অবশ্য সুন্দরী। ভালো মেয়ে। নাড়ু ডেকোরেটারের ব্যবসা করে। মা কে ও খুব যত্নে রাখে। অনেক জায়গা ভ্রমন করিয়ে এনেছে।
যাক। অনেক লতায় পাতায় জড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের গল্পকথা।
ভোলানাথ আর সুধাময়ী শুঁড়ি পাড়ার লাগোয়া দলুই পাড়ায় তাদের ছোট্ট কুটির বাঁধল। সেখানেই বসবাস করে। ভোলানাথের কাজের অভাব হওয়ার কথা নয়।
সুদক্ষ মিস্ত্রী। তার মতো মাটির ঘরের নৌকা চাল এর কাঠামো বানাতে আর কেউ পারতনা। অনেকে তার কাছে কাজ শিখেছে। আবার রাজমিস্ত্রি হিসাবে ও ছিল ওস্তাদ। অযোধ্যা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আদি বাড়ির কাঠামো তৈরী থেকে দেওয়াল প্লাস্টার ; মেঝে তৈরি সব তার হাতেই। আমার দাদু ; বিদ্যালয়ের  প্রতিষ্ঠাতা তথা প্রধান শিক্ষক এলাকার ' বড় মাষ্টার ' ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায় এই মানুষ টিকে খুব ভালোবাসতেন। আমি ও ভোলাদাদু বলতাম। আর ডেলা দিদি। একমনে কাজ করতো। কথা কম বলত ভোলাদাদু।
দীর্ঘদিন বেঁচেছিল এরা। ভোলা দাদুর শরীর চর্চা বলতে ছিল সাঁতার। পুকুরের এপার ওপার করা। ৭৫ বছর বয়সেও তর্ক করে সাইকেল চালিয়ে ছেলেদের কাছে রসগোল্লা আদায় করত।ছেলেদের সাঁতার শেখাত।
আর ডেলা দিদি ; তার মতো ধাই মা তখন আর কেউ ছিলনা। ধাই মা বললেই  সেই দলুই পাড়ায় সুধাময়ী ধাত্রী। যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল।মায়ের কাছ থেকেই কাজ শিখেছিল। তরীবালা যথেষ্ট অভিজ্ঞ ছিল। নানা ভেষজ ওষুধ জানত। মেয়েদের বাচ্চা আসছেনা কি গোপন গর্ভপাত কি প্রসব যন্ত্রনা কমানো র নানা জড়িবুটি জানত সে। সেখান থেকেই শিক্ষা সুধাময়ী র।
তার নির্দিষ্ট পরিমান জানত। সামনেই জঙ্গল। সেখান থেকেই সংগ্রহ করে আনত লতা গুল্ম। এই জ্ঞান কে আমরা কাজে লাগালাম না। এই পরম্পরা বাহিত জ্ঞান কে আধুনিক বিজ্ঞানের আলোতে বিশ্লেষণ করে অনেক দামী কাজ করা যেতে পারত। আমাদের আধুনিক বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান গুলির বা প্রশাসক দের আগ্রহই নাই।
শুধু চাকরি। মোটা বেতন।
ভোলাদাদু কিন্তু রোগভোগ বেশী করেনি। সামান্য এক দুদিনের অসুস্থতা। যাবার আগে বলেছিল ' আমাকে নিরামিষ রান্না করে দাও' '। সেই খেয়েই তার জীবন থেকে প্রস্থান। তবে শেষের দিকে খুবই অভাবে কেটেছিল  জীবন।  নিজের যন্ত্রপাতি গুলো ও বেচে দিতে বাধ্য হয়েছিল। তখন তো আর কাজ করার ক্ষমতা ছিলনা। প্রায় ভিক্ষুকের অবস্থা। অথচ এই অভাব ভোগ তার প্রাপ্য ছিলনা। কিন্তু হায় আমাদের সমাজ ব্যবস্থা! সামাজিক নিরাপত্তা বলে তো কিছু নাই। বার্ধক্যে দারিদ্রই সম্বল।
ডেলা দিদি তারপর ও বেঁচে ছিল বেশ কিছু বছর। যথেষ্ট ভুগতে হয়েছিল তাকে। শরীরের একদিক অসাড় হয়ে গিয়েছিল। সেবা যত্ন যথাসাধ্য করেছিল হারা দি বা তার ছেলে নাড়ু।
আমরা ভুলে গেছি এদের। বা মনে রাখার কি বা দায় এই স্বার্থমগ্ন সমাজের।
মা তরীবালা ; বাবা শচীনন্দন এর মেয়ে সুধাময়ী ধাত্রী
আর ভোলানাথের প্রেমকাহিনী  সেদিনের সমাজের রক্তচক্ষু কে উপেক্ষা করে  প্রেমকে মর্যাদা র আসনে বসিয়েছিল। সমাজের উপেক্ষা ছিল ; অবজ্ঞা ছিল ; কিন্তু তাঁরা দারিদ্রের সাথে ই মাথা উঁচু করে বেঁচেছিল।
গ্রামীণ সমাজে এই সব ধাত্রীমাতাদের অবদান কম ছিলনা। সমাজ সামান্য কিছু সম্মান তাদের যে করেনি তা নয়।
ছেলের অন্নপ্রাশন বা বিয়েতে তাদের আমন্ত্রন করা হত। ছেলের অন্নপ্রাশন এর থালার সাজানো সব খাবার প্রাপ্য ছিল এই ধাই মায়ের। তার সাথে শাড়ী ; কিছু টাকা তাদের দেওয়া হত।
এঁরাই তো একমাত্র ভরসা ছিলেন গর্ভবতী মহিলাদের। প্রসবের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই গর্ভধারিণী র পরিচর্যা তাঁরা ই করতেন। আবার প্রসবের পরও কমপক্ষে এক মাস। তা ছাড়া নানা উপসর্গে তাঁদেরই ডাক পড়ত।
বাঁশের সুক্ষ ছিলা দিয়ে নাড়ি ছেদন করে তা মাটিতে পুঁতে আসার কাজ করা সেই ধাত্রীমাতারা একটা সময়ের প্রতিনিধি। যা উপেক্ষণীয় কিছুতেই নয়।
ধাত্রী পান্না রা ছিলেন।ধাত্রী বললেই যে নাম মনে এসে যায় প্রথমেই। কিন্তু আমাদের এই গাঁ ঘরে আমাদের ধাত্রী মা রা ও ছিলেন।
আজ তাঁরা  ইতিহাস।
  সে ও ভোলার নয়।

ভোলানাথ সূত্রধর। আদি বাড়ি আদুরিয়া অমরপুর।
   পিতা মাতা : জানতে পারা যায়নি।
সুধাময়ী ধাত্রী (দলুই) : পিতা। শচীনন্দন (শশী)
   মাতা। তরীবালা বা তরুবালা দলুই
হরিদাসী দলুই। এখন বয়স ৭২ বছর। পিতা :
  মাতা : ভবানী দলুই পিতা সিদ্ধেশ্বর
নাড়ু দলুই। এখন বয়স ৫১। পিতা : নবকুমার দলুই।
মাতা : হরিদাসী দলুই।
এই দলুই পাড়ার প্রাচীন মানুষ এই শচী ; শশী ; কর্ণ ; কুমা বা কুমাই দলুই রা। আর কেউ বেঁচে নেই। কিছুদিন পরে আর কিছু বলার মতো আর কেউ থাকবে না।
  গ্রাম। অযোধ্যা। পো। বনকাটি। থানা। কাঁকসা। জেলা প বর্ধমান।