।। কথা - সাতকাহন।। ২৮ অধ্যায়
ভবিষ্যতে এ ছেলেকে দেখবে কে। তার তো কোন আত্মীয় এখানে নাই। চাল চুলো কিছু নাই। আত্মীয় স্বজনেরা একসাথে এখানে গ্রামের বাড়িতে
এলে থাকার খুব অসুবিধা হয়ে যায়।তখন নানা আত্মীয়ের এ বাড়িতে আসার চল ছিল। শ্রীচন্দ্রপুরের শ্যামা ঠাকুমা রা আসতেন। তাঁর মেয়ে তরু মাসীকে নিয়ে। নানা জায়গায় চালাঘরে বা বারান্দায় ভাগাভাগি করে থাকতে হত সবাইকে
মিলে মিশে কখনও বা পশ্চিমে র একচালা বারান্দা ঘরে ও কাউকে জায়গা নিতে হয়। উত্তর দিক থেকে সে চালাঘরে আবার মাঝে মাঝে সাপ এসে ও ঢোকে। সেই ভয় নিয়েই
মাটিতে তাল পাতার চাটাই মানে তালাই কাঁথা পেড়ে ঘুমাতে হত । একসময় ঘুম আসে। এসেই যায়। এ নিয়ে কারও কোন ক্ষোভ বিক্ষোভ ছিলনা।
কোন দুর্ঘটনা অবশ্য ঘটেনি কখনও।
দিনের দিকে অযোধ্যা থেকে অনেকে বেড়াতে আসত। দাদু দিদিমা মানুষ ভালো বাসে। কেউ রাতে ও থেকে যেত। গল্পে গল্পে রাত বেড়ে যেত।
এই গ্রামে তার একটা মাটির ঘরের জন্য উপযুক্ত জায়গা আর মিলছেনা। যে কটা জায়গা দেখা হচ্ছে সব জায়গা তেই
বাধা আসছে।
শেষ পর্যন্ত ডাকবাংলো র ধারে কিছুটা খাস জায়গা আর কিছুটা বনকাটির রায় দাদুদের জায়গা মিলিয়ে তিন কাঠা জায়গা র উপরে একটা ঘর তোলার পরিকল্পনা হল।
এ পাড়া থেকে ওপাড়া। পূর্ব বাউড়ী পাড়া।
এখন ভাবে ওখানে কি থাকা যেত! না সম্ভব ছিল। কিন্তু তখন
এসব ভাবনা কি কারো মাথায় আসেনি।
টাকা কোথায়? যে ঘর তুলবে।
সে এথোড়া বাড়ি কে গেল। পৈতৃক বাস্তুভিটা টুকু কাকা জ্যাঠা দের সমান করে ভাগ করে কিনে নিতে বলল।
তাঁরা রাজি হলেন। স্ট্যাম্প পেপারে লেখা হল। সামান্য কিছু টাকা হাতে নিয়ে সে ফিরল। সেই টাকা তেই শুরু হল ভিত কাটার কাজ। দক্ষিণ মুখী বৈঠক খানা র মতো একটা ঘর।
মাঝে সিঁড়ি। ওপারে আর একটা ঘর। মূল ঘর পূর্ব মুখী।
ঘরের কাঠামোর জন্য তাল গাছের কাঁড়ি চাই। দাদু চেয়ে চিন্তে তিনটে তালগাছ জোগাড় করল। কলিমউদ্দিন সেলিমুদ্দিন দুই ভাই তাকে ফেড়ে চেঁছে বানিয়ে দিল কাঠামো
তোলার উপযুক্ত করে। যৎসামান্য পয়সার বিনিময়ে। এরা পরেও তার আরও উপকার করেছে। দেয়াল তুলল বেশ কয়েকজন মিলে। কাঠামো তুলল দিদিমার বাপের বাড়ি র
অমূল্য মিস্ত্রি আর বনকাটির বাদল বনমালী দের বাবা মদন মিস্ত্রী।
খড়ের ছাউনি। ছাউনির নিচে শরকাঠির পাকানো গোছা - 'গুরুল'। কড়িকাঠের উপর মোটা করে এই গুরুল পেতে তার উপর মাটি লেপে উপর কোঠা। তখন এমনটা হত।দপদপ করত। পাতনের জন্য মোটা কাঠের পাটা কোথায় আর পাওয়া যাবে।
বিল্ল্বেশ্বর বাগদী ঘরের দেয়াল ঘষে মেজে ' খড়ুটি ' করে দিল। বড়ো ভালো মানুষ ছিল। নানা রকমের কাজ জানত।
অল্পস্বল্প রাজমিস্ত্রী র ও কাজ।
বাকি টাকা আনার জন্য বেশ কয়েকবার এথোড়া যেতে হয়েছে। কখনও বা খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। অথচ যাতায়াতের খরচ আছে। ঐ টিউশনি র টাকা।
ঘর একটা দাঁড়াল বটে। কিন্তু এপাড়া ওপাড়া সংসার নিয়ে টানাটানি করা কি আর যায়। সীমানা প্রাচীর হয়নি। যা ভবিষ্যতে আর হবে না। বা ঐ ঘরে বসবাস ও হবে না। পৈতৃক ভিটা টুকু গেল মাত্র। অবশ্য থাকলেও কি তার থাকা হত ওখানে।
চারদিকে উইপোকার ঢিবি। কয়েক দিন গ্রামের কিছু ছেলে কে নিয়ে ওই ঘরে বসে পড়ায়। কোন রকমে একটি দরজা বসেছে। জানালার ফাঁকে বাঁশের কঞ্চি গোঁজা। দু এক দিন প্রায় সমবয়সী গরীব মানুষের ছেলেদের নিয়ে সন্ধ্যায় বা রাত্রে বসে। নানা আলোচনা ; গল্প হয়। ব্যস ; বড় জোর এই টুকু ই। রাত্রে আর থাকা হয়নি কখনো সেই ঘরে।থাকার মতো অবস্থা ও ছিলনা। কেননা মামারা চলে যাবার পর আবার বৃদ্ধ দাদু দিদিমা একা। দেখতে তো সে ই। সাংসারিক এবং পারিপার্শ্বিক এক বিশেষ পরিস্থিতি তে এই ঘর তোলা হয়েছিল।
ইতিমধ্যে পশ্চিম বঙ্গে রাজনৈতিক পালা বদল ঘটে গেছে।
সিদ্ধার্থ বাবুর জমানার কালো দিন মুছে নতুন দিন এসেছে।
এসেছে বামফ্রণ্ট। পশ্চিম বঙ্গের ইতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বদল। জ্যোতি বাবু ঘোষণা করেছেন রাইটার্স থেকে রাজ্য পরিচালিত হবেনা। ক্ষমতা র বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। পঞ্চায়েত গঠিত হবে। এই সময়ের কথা আলাদা ভাবে অন্য অধ্যায়ে বলতে হবে।
'৭৮ এর অজয়ের প্রলয়ঙ্করী বন্যা। শত শত মানুষ গৃহ হীন।
মুলতঃ পূর্ববঙ্গীয় মানুষেরা যাঁরা নদী চর ; মানায় বাস করতেন। বসুধা সম্পূর্ণ ভেসে গেছে। ভেসে যাওয়া মানুষ কে
উদ্ধার করতে আখের রস সিদ্ধ করার যে ' ডেঁক ' সে নিয়েই
বনকাটি র নিমাই সমাদ্দার রা জলে নেমে পড়েছে। সে ছিল অসম সাহসী।
অযোধ্যা হাই স্কুলের কোন রুম আর ফাঁকা নাই। শরণার্থী তে
ভর্তি। তাদের জন্য যথাসম্ভব শুকনো খাবার জোগাড় করা হয়েছে। কো- অপারেটিভ বিল্ডিং এর চত্বরে বিরাট বিরাট
কড়াই এ খিচুড়ি চেপেছে। প্রয়াত মোহন চ্যাটার্জি র নেতৃত্বে
ওদিক টা দেখা হচ্ছে। অনেকে স্বেচ্ছাসেবক এর দায়িত্ব পালন করছেন। রান্না শালা সামলানোর জন্য অনেক কে যুক্ত করা হয়েছে। আবার ভাণ্ডার সামলানোর জন্য দুজন পাকা লোককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পানাগড় থেকে নেতৃত্ব স্থানীয় রা মাঝে মাঝে এসে খোঁজ খবর নিয়ে যাচ্ছেন। ত্রান সামগ্রী নিয়ে আসছেন কর্মী বাহিনী। স্বেচ্ছাসেবক রা।
গবাদি পশুদের জন্য খড় জলের ব্যবস্থা হয়েছে। বাচ্চাদের দুধ। ওষুধ। চিকিৎসক। অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও নানা ভাবে সাহায্য করছেন। এই পরিস্থিতি সামলে ওঠা সহজ কথা
ছিলনা। ছোট খাটো বিতর্ক ; মনোমালিন্য ; বা ক্ষোভ বিক্ষোভ যে দেখা দিচ্ছে না তা নয়। বিনোদ মণ্ডল একদিন বেশ জোর গলায় বিলি বন্টন নিয়ে প্রতিবাদ করল। সাতকাহনিয়া র মানুষ দের ঘর দোর যায়নি। কিন্তু চরম অভাব। শর আর খড় দিয়ে
ছাওয়া ঘরের ভিতর আর কারো শুকনো নাই।ত্রিপল দরকার। কেরোসিন তেলের হাহাকার। আমাদের নিজেদের ঘরে ও নাই।
হাফ প্যান্টের উপর গামছা বেঁধে হাতে লাঠি নিয়ে কেরোসিন তেল আনতে সে আর কানু যাচ্ছে ইলামবাজার। তখন জল অনেক নেমে গেলেও কোথাও কোথাও হাঁটু জল আবার সাঁতার জল। বসুধা পার হওয়া দুষ্কর। তবু পার হয়েছে।
ইলামবাজার এ কানুর শ্বশুর মশাই প্রয়াত শ্রীধর পাল মশাই
পাঁচ লিটার তেল জোগাড় করে দিলেন। ইলামবাজার হাই স্কুল বিল্ডিং এও বন্যা দুর্গত মানুষদের আশ্রয় শিবির। সেখানেও একই ব্যবস্থা করেছেন ওপারের কর্মী বাহিনী।
সাবধানে তেল আনতে হচ্ছে। পাকা রাস্তা র উপর দিয়ে বড় বড় মাছ পেরিয়ে যাচ্ছে। লাঠি দিয়ে দু টো মেরে কোন রকমে তালপাতা দিয়ে ঝুলিয়ে ডাঙ্গাল হয়ে বাড়ি এসেছে।
পাড়া প্রতিবেশী দের লম্ফ জ্বলার মতো একটু একটু করে
দিতে হয়েছে। এক দল মানুষ কে নিয়ে কো অপারেটিভ বিল্ডিং এ যাওয়া হল। যাদের ঘরে খাবার নেই তারা এখানে খাবে। ব্যবস্থা হল।
গুসকরা মোড়ে র কাছে অনেক মানুষ ; স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা
খাবার ; পোষাক দুর্গত মানুষ দের হাতে তুলে দিচ্ছেন।
অনেকে গুসকরা রাস্তা ; মোরাম চাতালের উপর উঠে এসেছিলেন। মূলতঃ তাঁরা ই আর বসুধা বিলপাড়ার মানুষ রা
এই সাহায্য পেয়েছিলেন।
সে কি ভয়ংকর দিন রাত। এখনো মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। জল বাড়ছে। তবে এই রূপ নেবে তা ভাবা যায়নি।
মাটির বাঁধ এককিলোমিটার ভেঙ্গেছিল। সাতকাহনিয়া য়।
সে কি কাজে ইলামবাজার গিয়েছিল। ফেরার সময় দেখে বাঁধের গোড়ায় জল। বাঁধ যেন কাঁপছে।
পূর্ব দিকটা ধূ ধূ সাদা। কমপক্ষে এক হাজার বিঘা দোফসলি জমি গড়ে তিন ফূট বালি চাপা পড়ে গেছে। কত চাষির লম্বা লম্বা আখ ছিল। আরও কত ফসল। আর মৃত গবাদি পশুর
দেহ ছড়িয়ে আছে সর্বত্র।বসুধা বরুল বিল মাঠে সব চেয়ে
বেশী।
জল বেশ দ্রুত ই নেমে গিয়েছিল। নীচে আরও দু তিন জায়গায় ভেঙ্গেছিল। এগারো মাইল গুসকরা মোড়ে গিয়ে
দেখা পেল আকুলিয়ার মানুষের। কি খবর। না মোটামুটি সব ঠিক আছে। হ্যাঁ গো ক্ষুদু দের কি খবর। না। ঠিকই আছে।
কালিকাপুর ঠিক আছে। মৌখিরা র একতলা বিশিষ্ট ঘর জলে ভরে গিয়েছিল। সব মানুষ জমিদার বূড়ো বাবু দের দোতালা দালান ঘর গুলো তে আশ্রয় নিয়েছিল। সে প্রায় কম পক্ষে শ দুয়েক মানুষ। দুর্গাদালান জলে ভর্তি। প্রতিমার কাঠামো কোমর জলে দাঁড়িয়ে আছে।
১০ ই আশ্বিন।বুধবার দিন তারিখ টা বুকে গেঁথে আছে এই এলাকার মানুষের। আশ্বিনে বৃষ্টি নামলে সেই ভয় আজও তাড়া করে।
----------- ----------- ----------- ----------- ------- © প্রণব ভট্টাচার্য
( খড়ুটি ' মানে হচ্ছে মাটির দেয়ালের উপর বালি মাটি দিয়ে প্লাষ্টার। কর্ণিক এবং ঘষার পাটা দিয়ে সমতল করন)
গুরুল - পাকা শর কাঠি দশ বারোটা আঁটি করে খড় দিয়ে বাঁধা। যেমন মাপ তেমন জুড়ে জুড়ে করা যায়